- শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

বাবার স্মৃতিচিহ্ন

রত্না চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৮:০৮, ১৫ নভেম্বর ২০২১

বাবার স্মৃতিচিহ্ন

আমরা সাত ভাইবোন। বাবার সাত রকমের আদরে বেড়ে উঠেছি। সাত রকমের আদর বলার কারণ, কখনো কোনো বাবা মা তাঁদের সব সন্তানকে একরকম আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে পারেন না। কম বা বেশির তুলনা নয়, এটা আমার একান্ত অনুভূতি থেকে বলা। বাড়ির সবাই বলতো বাবা নাকি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন! বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে শুনতাম, বাবা নাকি ছেলেবেলায় আমাকে দুষ্টুমির জন্য কঞ্চি নিয়ে মারতে গেলে বলতেন, ‘ছুটে পালা আমি কিন্তু মারতে আসছি’! এই ঘটনাটা আমার কাছে মোটেও ভালোবাসার মনে হয় না, এটা ছিল সন্তানের প্রতি বাবার মায়া। মায়া আর ভালোবাসা দুটোই আলাদা শব্দ, সমার্থকও নয়। যেটাই হোক, এমন আরো অনেক ঘটনা আছে বাবাকে আর আমাকে ঘিরে। সেসব এখানে বলে শেষ করা যাবে না। আজ বাবাকে নিয়ে লিখতে বসার কারণ একটা চায়ের কাপকে কেন্দ্র করে।
আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর বন্ধু বান্ধব প্রায় সবাই পরপারে চলে গেছেন, তাঁকে একা করে। এজন্য তিনি আর শহরের দোকানে চায়ের আড্ডায় যান না। কারণ তাঁকে সঙ্গ দেয়ার মতো বন্ধুদের কেউই বেঁচে নেই।
আসরের আজান দিতেই হাতে লাঠি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে আমাদের গ্রামের মসজিদের দিকে যেতেন। নামাজ শেষ করে মসজিদের পাশে ছোট্ট চায়ের  টংদোকানে বসতেন। এই চায়ের দোকানে বসা নিয়ে বাড়িতে প্রতিদিনই ঝামেলা হতো মা ভাইদের সাথে। মা আর ভাবি বলতো নোংরা, তেলচিটে কাপে চা বিক্রি করে বেটা, তবু কেন ওই দোকানের চা খেতে হবে প্রতিদিন? আসলে বাবাকে বাড়িতে প্রতিদিন যে চা দেয়া হতো, তাতে চিনি থাকতো না। দোকানিকে যাওয়ার সময় বাবা বলে যেতো, ভালো করে কড়া হিট দিয়ে একচামচ চিনি দিয়ে এককাপ দুধ চা বানাও, আমি ততোক্ষণে নামাজ পড়ে আসি। প্রতিদিন চা খাওয়ার কারণ ওই এক চা চামচ চিনি।
একদিন সকালে মা হাঁটতে বেড়িয়েছেন, তখন ওই চা বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হলে, মা তাকে কিছু কথা বলেন। ‘শোন বাবা তোর কাকার কিন্তু ডায়াবেটিস, চায়ে চিনি দিস না, আর কাপটা পরিষ্কার করে দিস, সবার খাওয়া কাপে ওমন খপ করে পানিতে চুবিয়েই চা দিস না।’ একথা শুনে ওই চা বিক্রেতা ভাই মাকে বলে, কাকা তো রোজ দু’বেলা আমার কাছ থেকে চিনি দিয়ে চা খেয়ে আসে কাকি, আমি তো জানতাম না! কাকাও বলেনাই কোনোদিন! এরপর একটু অসুস্থ হলেই মা আর মেজভাই বলতো ‘যাও চিনি দিয়ে চা খাও বেশি করে।’
তবু চা খাওয়া বাদ পরেনি বাবার। আসরের নামাজ শেষে চা খেয়েই বাড়ি ফিরতেন তিনি। শুধু বদলে গিয়েছিল তাঁর চায়ের কাপ, চিনি বহাল রেখেছিলেন দোকানিকে চোখ রাঙিয়ে। বাড়ি থেকে আমাদের বাবাকে কাপ নিয়ে যেতে হয়েছিল ওই দোকানে।
বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন গতবছর ১৪ সেপ্টেম্বরে। বাবা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর ওই দোকানের সামনে দিয়ে আমরা কয়েকজন যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ে গেলো বাবা তো চা খেতেন এ দোকানে, আমরাও গেলাম চা চাইলাম, দোকানি চা বানাতে বানাতে বাবার কথাই বলছিলেন। চা খেতে খেতে চোখ পড়ে তারের সঙ্গে ঝুলন্ত একটা কাপের দিকে। দোকানির চোখও ঠিক একই জায়গায়। আমি কিছু বলার আগেই দোকানিভাই বলে উঠলো, আপা কাকার কাপে আমি কিন্তু কোনদিন কাউকে চা দিই নাই। কাকা তো আমারও বাবার মতো ছিলেন। কাপটা থাক আমার দোকানে? এটা কাকার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিবো। চা শেষ করতে পারলাম না, বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেন গুড়িয়ে যাচ্ছিলো, চোখ জ্বালা করে উঠতেই কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে  চলে আসি।
আসতে আসতে ভাবি, চা-দোকানি ভাই আমাদের বাবার চা খাওয়ার কাপটা আপনার কাছে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকুক, আর আমার কাছে থাকলো তাঁর চায়ের দারুণ অভ্যেসটা। প্রতিদিন চায়ের কাপে চুমুকের আগে মনে পড়ে তোমাকে বাবা, তাই হয়তো ইদানিং চা মানেই তুমি। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী ছাগীরা।

১৩/১১/২০২১ ইং:

ঢাকা, বাংলাদেশ।

আর সি