এ দেশে প্রথম যেদিন আমি আসি, সেদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলে বিমানটি ফিনল্যান্ডের ওপর দিয়ে খানিকক্ষণ উড়ে হেলসিঙ্কি-ভান্তা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের রক্তচক্ষুর ভয় কাটিয়ে বাইরে যখন এলাম, তখন সে কি শান্তি! মনে হলো, যাক, আমি অবশেষে আমার গন্তব্যে পৌঁছেছি। এ জন্য শেষ ছয় মাস কত কী না করতে হয়েছে আমাকে। দরজা থেকে দরজা, অফিস থেকে অফিস, অপেক্ষা, মায়ের গয়না বিক্রি, বাবার কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ আর না খেয়ে খেয়ে নিজের হাড্ডি-চামড়া এক করে ফেলা। লবিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
পরে চোখের পানি মুছে মনে হলো এখন কী করব, কোথায় যাব। দেশ থেকে আসার সময় তেমন কারও সঙ্গে কথা বা যোগাযোগ করতে পারিনি। পরিচিত কেউ থাকে না এ দেশে। তারপর মনে হলো, আমার গন্তব্য তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমাকে আরও ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। যেতে হবে কউপিও নামে অন্য একটা শহরে।
ব্যাগগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটা চেয়ারে বসলাম। সময় তখন সন্ধ্যা ৮টা ১০ মিনিট। বাইরে তখনো অনেক সুন্দর আলো। আর পেটে ভীষণ ক্ষিধে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে যে বিমানে উঠেছিলাম, সেটি ফিনল্যান্ডের বিমান। খাবার বলতে একটি স্যান্ডউইচ শুধু। আসার সময় আসিফ ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল দিল্লির ফিনিশ দূতাবাসে। তিনি তাঁর পরিবারের ভিসা অ্যাপ্লিকেশান জমা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। সেই ভিসা এখনো হয়েছে কি না, জানি না। তিনি এখানে ব্যবসা করেন। কিসের ব্যবসা, জিজ্ঞেস করা হয়নি। ভাবলাম, যদি আসিফ ভাইকে না পাই তাহলে ইনফো ডেস্ক থেকে কউপিও যাবার রাস্তা জিজ্ঞেস করে নেব।
এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে এতই ক্লান্ত যে, আর কিছু চিন্তা না করে আসিফ ভাইয়ের ফোন নম্বর খুঁজে বের করলাম। ফোন করে জানতে পারলাম তখনো তিনি কাজে। আর দুই ঘণ্টা পর কাজ শেষ হবে। তখন এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
একটা চেয়ারে বসে চারপাশ দেখছি আর ভাবছি, দেশে যখন কোনো বিদেশি সাদা চামড়ার মানুষ দেখতাম, তখন আমার খেলনা পুতুলের কথা মনে হতো। কারণ, পুতুলের চুলও সাদা আর বিদেশির চুলও সাদা। আর এখন আমার চারপাশে এত সাদা চামড়ার মানুষ দেখে মনে হচ্ছে, আমি নিজেও মনে হয় ওদের কাছে কোনো পুতুলের মতো! চিন্তা করে খারাপ লাগল, আবার হাসিও এল।
যা হোক, আসিফ ভাইয়ের বাসায় ওই রাতটি থেকে পরের দিন কউপিও গেলাম। আসিফ ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, শহরটি নাকি খুব সুন্দর। মনে মনে ভেবেছিলাম, যদি কাজ পাওয়া যায় তাহলেই ভালো, সুন্দর দিয়ে আমি কী করব? লজ্জায় আসিফ ভাইকে কাজের কথা আর জিজ্ঞাসা করিনি। বেচারার বউ নেই, নিজেই রান্নাবান্না করে খেতে দিল। ভাবলাম, এ অবস্থায় আবার কাজের কথা বলা ঠিক হবে না।
কউপিওতে আসার পর প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছি। নতুন সব সাদা চামড়ার বন্ধুর সঙ্গে যদিও মন খুলে কথা হয় না, কিন্ত ঠিকই ক্লাস করে যাচ্ছি। আমার দেশ, আমার ধর্ম আর সংস্কৃতি নিয়ে নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যখন একা বসে থাকতাম, তখন দেশের কথা মনে হতো। মায়ের কথা মনে হতো সবচে বেশি। দেশে যখন ছিলাম, প্রতিবেলা ফোন করে মা জিজ্ঞাসা করতেন, খাবার খেয়েছি কি না, শরীর ভালো কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন আমি মাকে ফোন করলে তখনই কথা হয়, তা–ও আবার অল্প। মায়ের চোখে জল জমার আগেই লাইনটি কেটে দিতে হয়। কিংবা মা কাঁদবেন মনে হলেই কাটতাম। কান্না যাতে শুনতে না হয়। মায়ের কিছু গয়না বিক্রি করে ৫০০ ইউরো নিয়ে এসেছিলাম। দিন যাচ্ছে, প্রতিবেলা খাচ্ছি, আর আমার মনে হচ্ছে, এ আমি কী করছি! আমি কিসের টাকা খরচ করছি।
আমার রুমমেট একটি দোকানের মেনু বাসায় বাসায় গিয়ে মানুষের পোস্ট বক্সে দিয়ে আসে। এক বছর ধরে সে এই কাজটি করছে। ৫০০ মেনুর জন্য ২০ ইউরো করে পায়। কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে তাতে যতটুকু পারে মেনু পেপার নেয় আর এক বোতল পানি নিয়ে বের হয়ে যায়। ঘণ্টা তিনেক পরে যখন ফেরত আসে, দোকান মালিকের বিক্রি ভালো হলে খেতে দেয় আর খারাপ থাকলে টাকা দিয়ে দেয়। আমিও ওই কাজটি করতে চাইলাম। কিন্তু কউপিওতে এমন কাজ আর নেই। আমি চেষ্টা করেও কোনো কাজ পেলাম না। এ অবস্থায় আমি আসিফ ভাইকে ফোন দিলাম। ভাবলাম, তাঁর রেস্তোরাঁয় যদি এ ধরনের কোনো কাজ থাকে। তিনি হেলসিঙ্কিতে এমন একটা কাজ দিলেন। হেলসিঙ্কিতে এসে তিন দিন থাকতে হতো। এভাবে মাসের আর যাতায়াত খরচ উঠানো যেত। ছয় মাস এই কাজ করেছি। মেনু ডেলিভারি দেওয়া কি যে কষ্টের কাজ, যে কখনো করেনি সে বুঝবে না। এ কাজ করার সময় অন্তত শান্তি পেলাম, মায়ের গয়না বিক্রির টাকাটা বাঁচাতে পেরেছি।
তার কিছুদিন পর মরক্কোর এক বন্ধুর মাধ্যমে কউপিওতে ইতেল্লার পত্রিকা বিলির কাজ পেলাম। মেনু ডেলিভারির মতোই কাজ। পার্থক্য শুধু মেনু ডেলিভারি দিনে আর পত্রিকা বিলি ভোররাতে। তারপর মাঝে মাঝে অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে শপিং মলগুলোতে ট্রলি গোছানোর কাজে যেতাম। সব কাজই করতে হতো বাইরে। গরমকালে এসব কাজ করা সহজ কিন্তু ঠান্ডায় চোখের পানি দোষ দিত নিজের জন্ম নেওয়াকে। কষ্টের প্রতিটি ক্ষণ মনে করিয়ে দিত এই নিষ্পাপ জীবনের ছোট ছোট অন্যায়ের সাজা হিসাবে প্রাপ্য খেসারতগুলো।
আর এভাবেই নিজের খরচ আর মাকে মাস শেষে খরচের কিছু টাকা দিয়ে যেতাম। দেখতে দেখতে তিনটি বছর পেরিয়েছে। প্রতিটি মাস ছিল হিসাবের। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতো, আর কতদিন এভাবে। শুধু কি এর জন্যই জীবন! এই সময়ের মধ্যে আরও দেশি ভাইয়েরা এল। তারাও আমার মতো চিন্তায় আর কাজের খোঁজে দিন কাটিয়েছে। কোনো একসময় আমার জায়গায় আবার মাঝে মাঝে অন্য কোথাও কাজ জুটিয়ে দিয়েছি। সবাইকে দেখেছি নিজের খরচ চালানো আর কিছু থাকলে অল্প করে দেশে পাঠানো নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকতে। একসঙ্গে সবাই আড্ডা দিয়েছি, মজা করেছি, রান্না করে খেয়েছি। কিন্তু তার পরও প্রতিটি একান্ত মুহূর্তে হারিয়ে গিয়েছি নিজস্ব কোনো একান্ত মুহূর্তে। খুঁজে ফিরেছি নিজের আপন কাউকে, যেখানে মাথাটা রেখে অল্পক্ষণের জন্য হলেও সব ভুলে যেতে পারি!
পড়াশোনার শেষের দিকে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি করতে হেলসিঙ্কি এলাম। ব্যবসায়িক শাখার ছাত্র বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকা দেবে না। কারণ, এ খাতে কোনো ফান্ড নেই। কোম্পানিও বেতন দেবে না। তাই ইন্টার্নির পাশাপাশি আবার কাজ খোঁজা। হেলসিঙ্কিতে কাজ পেতে আরও কষ্ট। কাজ কম কিন্ত কাজের লোক বেশি। ইন্টার্নিকে ঘিরে আমার একটা বিশ্বাস ছিল। আমার সাদা চামড়ার এক শিক্ষিকা বলেছিলেন, ‘দিজ উইল বি আন ইনভেস্টমেন্ট ফর ইউর ফিউচার ক্যারিয়ার।’ আমার পুঁজি ছিল আমার মেধা, সময় আর ইচ্ছে। যার ফলে পাঁচ মাস বিনা বেতনে কাজ করার পর একটি পদ খালি হওয়াতে তাঁরা আমাকে কাজে ডাকল। তবে এবার বেতন দিয়ে। তার পর থেকে আমাকে আর অন্য কোথাও কাজ খুঁজতে হয়নি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজেই মন দিলাম।
এভাবে ছয় বছর ফিনল্যান্ডে থাকার পর আজ আমার হাতে লাল পাসপোর্ট! সেটাতে আমার নাম এবং ছবি লাগানো। আমি এখন পুরোদস্তুর এদেশি নাগরিক। কিন্তু তার পরও আমি খুশি হতে পারছি না। গর্ব করে কিছু বলার মতো নেই। আজ টাকা উপার্জন করছি আগের চেয়ে বেশি। সেটিও খরচ বেড়ে গিয়েছে বলে। ভালো আছি, শরীর ভালো আছে বলে। তবে এখনো একাকিত্বে শিকড়ের টানে হারিয়ে যাই, ফিরে যাই ছয় বছর আগের সেই পড়ন্ত বিকেলে, যখন আমার বিমান অবতরণ করল ফিনল্যান্ডের মাটিতে।
এখন আমি যত গয়না মাকে কিনে দিই না কেন, বাবার দেওয়া মায়ের বিয়ের গয়না আমি কোথায় পাব। কষ্টে কষ্টে হারিয়ে যাওয়া সেই সব দিন আর ফিরে আসবে না। তাই আজ যখনই সময় হয়, লাল পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে ভাবি আর পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে রাখার চেষ্টা করি।
আর এ/আর এ এস