আমরা অনেকেই রূপকথার গল্প পড়ে বড় হয়েছি। ...এক যে ছিল রাজা। তার ছিল এক রানী। একদিন রাজা বিশ্ব ঘুরে দেখার জন্য সৈন্যসামন্ত নিয়ে বের হলেন। সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে অদ্ভুত এক রাজ্যে পৌঁছালেন...। অসম্ভব, কাল্পনিক আর অবাস্তবের সব গল্প। নিষ্পাপ স্বপ্নের মাঝে শিশুমনকে অজানা পাতালপুরী কিংবা মেঘের দেশ থেকে ঘুরিয়ে আনার আখ্যান। এখনও অবশ্য শিশুরা রূপকথাই পড়ে, তবে তা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি। যেখানে থাকে অসম্ভব কল্পনা, শক্তি অনুযায়ী ভাবার সীমাহীন দিগন্ত। তবে শিশুরা যতই বড় হতে থাকে ততই বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। চারপাশের কঠিন বাস্তবতায় শৈশবের সেই কল্পনা আর দুর্নিবার কৌতূহল অবচেতনে আটকে যায়।
শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি মূলত দাঁড়িয়ে থাকে মানব মনের অসম্ভব কল্পনা থেকে উৎসারিত ভাবনার জগতকে কেন্দ্র করে। যেখানে জানা, শোনা বা দেখার দুর্নিবার এক কৌতূহল প্রতিনিয়ত খেলা করে। ভাবনার জগতে যতই ঢুকে যাওয়া যায়, জানার পরিধি যতই বাড়তে থাকে, মানুষের কৌতূহলও ততই বাড়তে থাকে। শিল্প-সাহিত্যের মূল ভিত্তিটা কিন্তু সেখানেই। সাংবাদিকতাকে অনেকেই দ্রুততম সাহিত্য বা শিল্পের সঙ্গে তুলনা করেন। সে হিসেবে তথ্য বা সংবাদ জানা বা পড়ার দুর্নিবার কৌতূহল বা আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করেই টিকে থাকছে গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যম।
এটা সত্য, আধুনিক মানবসভ্যতার ভিত রচনা করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিস্ময় উন্নতি। গোটা পৃথিবীর চেহারা আর ধ্যান-ধারণাকেই আমূল বদলে দিয়েছে। আর এসবের পেছনে রয়েছে মানুষের জানা, দেখা আর জয় করার সীমাহীন কৌতূহল। এই কৌতূহল যাদের যতো বেশি তারা ততো বেশি জ্ঞানে-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানদের অন্যতম আলবার্ট আইনস্টাইনও মনে করতেন, মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি হলো যৌগিক আগ্রহ। বলতেন, তার মধ্যে কোনো বিশেষ প্রতিভা নেই। তিনি শুধুই নিজের কৌতূহলকে অনুসরণ করতেন। কৌতূহল মেটানোর জন্যই তার এতো সব কাজ করা। তবে তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন, কল্পনা হলো জ্ঞানের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
মানবসভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার মূলে যে কৌতূহল সেটা বিশ্বাস করতেন বিশ্বের প্রথম এনিমেশন প্রোগ্রামার এবং বিশ শতকের প্রভাবশালী প্রাযুক্তিক ভাবনার অধিকারী ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি বা ওয়াল্ট ডিজনি (১৯০১-১৯৬৬)। তিনি বলেছেন, আমরা শুধু সামনের দিকেই এগুতে পারি; আমরা নতুন দরজা খুলতে পারি, নতুন আবিষ্কার করতে পারি, কারণ আমরা কৌতূহলী। আর এই কৌতূহলই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
আর এই কৌতূহল নিবৃত্ত করতে যুগ যুগ ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে চর্চা বা জ্ঞান অর্জন করে আসছে মানুষ, অতীতে তা ছিল ধীর গতিতে। কেননা, আজকের মতো জ্ঞান অর্জনের এত বেশি উপকরণ তখন ছিল না। তবে বর্তমানে মানুষের জ্ঞান অর্জনের গতি বেড়েছে অবিশ্বাস্যরকমভাবে। বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে অর্জিত অতীতের তাবৎ জ্ঞান বর্তমানে এক সপ্তাহ কিংবা বলা যায় প্রতিদিনই দ্বিগুণ হচ্ছে। মানবসমাজ প্রতিনিয়ত জ্ঞানের জন্য লড়াই করছে। সে কারণে আজকের মানুষকে অতীতের চেয়ে আরো বেশি জানতে, পড়তে ও বুঝতে হচ্ছে। বেশি জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠতে হচ্ছে। আর এসবের পেছনে প্রতিনিয়ত শক্তি যোগাচ্ছে জানার প্রবল আগহ আর দুর্নিবার কৌতূহল।