- রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

যে গাছের বাকলের উপর মন্ত্র লেখা হতো এক সময়

ষ্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ১৭ এপ্রিল ২০২২

যে গাছের বাকলের উপর মন্ত্র লেখা হতো এক সময়

ভূর্জপত্রে গাছের বাকলের উপর মন্ত্র লেখা হতো এক সময়, এখনো হয়।জ্যোতিষীরা এসব মন্ত্র লিখে কবচ বানায় এবং এখনো কিছু গুপ্ত মন্ত্র লেখা হয় ভূর্জপত্রে। কাগজের তুলনায় এর আয়ুষ্কালও অনেক বেশি। ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট আকবরের আমল থেকে ভূর্জপত্রের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। তার আগে কালিদাস এবং শৈল্যচিকিৎসক সুশ্রুত ভূর্জপত্র ব্যবহার করেছেন। হিমালয়ের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার উঁচুতে বাস করা গাছ যদি সমতলেও দেখা যায়, তবে তা হতে পারে এক বিরল অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশের গাজীপুরের একশ বছরের পুরনো বলধা বাগানে আছে এই গাছ।বলধা আদতে গাজীপুরের একটি গ্রামের নাম যেখানে  ১৯০৯ সালে বলধা বাগানের প্রতিষ্ঠাতা করেন জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ।সেসময় নরেন্দ্রনারায়ণের জমিদারি ছিল এখানে। উয়ারী এলাকায় বলধা জমিদারের বাগান বলে লোকজন সেটা মুখে মুখে বলধা বাগান বলে অভিহিত করে।উয়ারী ছিল তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের বাস করার জন্য এক সম্ভ্রান্ত এলাকা যেখানে সাইকি অংশে নিজেও একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন নরেন্দ্রনারায়ণ।

বলধা বাগানের সামনে এগিয়েই ডানদিকে ভূর্জপত্র গাছ।কিন্তু ভূর্জপত্র নামে উল্লিখিত হলেও  এই গাছ প্রকৃত ভূর্জপত্র নয় যার বাকলে মন্ত্র লেখা হয়েছে। তবে এর থেকেও কাগজের মতো বাকল পাওয়া যায়। ঢাকা বলধা বাগানের উল্লিখিত গাছটি মোঃ মিজানুর রহমান বর্ণনা করেছেন Melaleuca leucadendra (L.)L যার আদিবাস মালাকু থেকে অস্ট্রেলিয়া।

ভূর্জপত্র গাছের ছাল উঠে যায় শীতকালে।এই ভূর্জ শব্দ থেকেই শীতপ্রধান দেশের ভূর্জ গাছের নাম হয়েছে বার্চ (Birch)।ভেবে অবাক হই, জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ দুনিয়ার অর্ধশত দেশ থেকে কীভাবে এসব গাছপালা সংগ্রহ করেছিলেন। সুদূর জাপান থেকে আনিয়েছিলেন ক্যামেলিয়া গাছ। রবীন্দ্রনাথ অণুপ্রাণিত হয়ে ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি  লিখেছিলেন, হয়তো সিবিলি অংশের জয় হাউসে নয়, কলকাতায় বসে। ছাপা হয়েছিল ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে। নোবেল  বিজয়ী অমর্ত্যসেনও এসেছিলেন বলধাতে ১৯৯৮ সালে যিনি লাগিয়ে গেছেন  ‘রাজ অশোক’-এর চারা।

যুবক ভূর্জপত্র গাছের বাকল নরম থাকে এবং বেশ সহজেই তুলে ফেলা যায়, বড়োসড়ো সাইজে। গাছ বেশি বড়ো হয়ে গেলে বাকল টুকরো হয়ে যেতে চায়। এর একটি কারণ লেন্টিসেল অর্থাৎ যার মাধ্যমে গাছ গ্যাস বিনিময় করে। অধিকাংশ লেন্টিসেল থাকে আনুভূমিক বা horizontal আকৃতির, তবে গোলাকার বা ভার্টিক্যালও দেখা যায়। আলুতে বা আপেলেও যে সব স্পট দেখা যায় সেগুলোও লেন্টিসেলের কারণে। অনেক সময় লেন্টিসেল দেখে ভ্রম হয়, গাছ বা ফল বোধ হয় রোগগ্রস্ত। বয়স বেশি হলে এই লেন্টিসেল বড়ো হয়ে গাছের কাণ্ডকে কিছুটা লাঙল-চেরা করে ফেলে যে-কারণে বাকল তেমন লেখার উপযোগী থাকে না। উনবিংশ শতাব্দিতে বাকলে যে সংস্কৃত লিপি লেখা হয়েছে তা সংরক্ষিত আছে জার্মানির তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ভূর্জপত্র গাছের বৈজ্ঞানিক নাম বেটু্লা ইউটিলিস (Betula utilis D. Don). Betula অর্থ বার্চ বা ভূর্জপত্র গাছ। utilis মানে প্রয়োজনীয়। এই গাছ থেকে মানুষের নানা প্রয়োজন মিটেছে বলেই এমন নাম হয়েছে প্রজাতির। ৫ কোটি বছর আগেও পাথরের ফসিলে ভূর্জপত্রের গাছ চিহ্নিত হয়েছে। পৃথিবী থেকে গত হিমবাহ যুগ শেষ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৭শ বছর আগে। হিমবাহ যুগ শেষ হওয়ার পর যে সব গাছপালা দ্রুত বনায়ন করেছে তার মধ্যে ভূর্জপত্র অন্যতম। অতএব বনায়নের জন্য ভূর্জপত্রের গাছ বেশ উপযোগী। হিমালয়ের ২ থেকে ৩ কিলোমিটার উচ্চতায় দেখা যায় দেওদার, ভুটিবাদাম (Hazel nut) ও ম্যাপেলের গাছ, এরও এক কিলোমিটার উপরে দেখা যায় ভূর্জপত্রের গাছ। হিমালয় অঞ্চলের সিকিম, ভুটান ও নেপালে এই গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে দেখা যায়। David Don ১৮২৫ সালে এই গাছ সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ করেন। Betula গণে প্রায় ৪০টি উদ্ভিদ দেখা যায় যার মধ্যে উপমহাদেশে পাওয়া যায় গোটা চারেক। মার্চ এপ্রিলে এর খাঁজকাটা পাতাগুলো ঝরার সময় অদ্ভুত সুন্দর সোনালি হলুদ রং ধারণ করে।

ভূর্জপত্রের ফুলে বায়ুপরাগায়ন হয়। এতে যে স্ত্রীফুল দেখা যায় (Female catkin) তার থেকে তৈরি হয় পক্ষল বীজ। এগুলো দেখতে প্রজাপতির মতো, যা হালকা বাতাসে বহুদূর উড়ে যেতে পারে। তবে বীজগুলো খুব ছোটো, প্রায় আনুবীক্ষণিক, ৩ মিলিমিটার হবে হয়তো। এর এক কিলোতে ৫ লক্ষ বীজ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। হিমালয় অঞ্চলে মাকড়ের জালে বা জানালার কাঁচের শার্সিতে এদের লেগে থাকতে দেখা যায়।

কিংবদন্তি থেকে জানা যায় শিব পরতেন বাঘের ছাল আর তার শিষ্যরা পরতেন ভূর্জপত্রের নরম বাকল। ভূর্জপত্রের ছাল শুধু কাগজ নয় নানা রকম মোড়কের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, মাখন যাদের অন্যতম। ঘরের ছাদ, ছাতার ছাউনি, ব্যান্ডেজ তৈরির কাজেও এর ব্যবহার হয়েছে। ভূর্জপত্রের গাছ থেকে সহজেই সুন্দর জ্বালানি কাঠ পাওয়া যায়। এবং এই জ্বালানি সংগ্রহের কারণে ভূর্জপত্রের জীবন বিপন্ন হয়ে এসেছে পৃথিবীর কিছু দেশে। ইউরোপে ভূদৃশ্যের জন্য এই গাছের বহুল ব্যবহার আছে।

আয়ুর্বেদ এই গাছ থেকে অনেক ওষুধ তৈরি করে। তবে সব ব্যবহারই বলতে গেলে ক্বাথ বা Decoction তৈরি করার পর। ৩-৪ কাপ পানি মিশিয়ে এর পাতা বা ছাল জ্বাল দিতে দিতে যখন এক কাপে এসে ঠেকে তখনই তা উপযুক্ত হয় ওষুধের ব্যবহারে। পিত্তশ্লেষ্মা, মূর্ছা, রক্তপিত্ত, বমি, পেটফাঁপা, কানের প্রদাহ এবং ক্ষত পরিষ্কার হয় এই ক্বাথ দিয়ে। তবে কাশ্মীরে এই ক্বাথের নিয়মিত ব্যবহার হয় বলকারী টনিক হিসাবে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে কিডনি ইনফেকশন ও এইডস্‌ রোগে একে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। 
 
 

আর সি