- রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

বাংলাদেশের ঢাকাই মসলিন বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড়

টোকিও বাংলা নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ২০ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের ঢাকাই মসলিন বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড়

ছবি:ইন্টারনেট

বাংলাদেশের ঢাকাই মসলিন আজ থেকে ২০০ বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড় ছিল। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই যেন গায়েব হয়ে গেল কাপড়টি। কিন্তু গায়েব হলোটা কিভাবে? আর কি আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব ঐতিহ্যবাহী সেই মসলিন?

মসলিন নিয়ে শুরু থেকেই বলা যাক। ১৮ শতকের ইউরোপের কথা। নতুন এক ফ্যাশন সে সময় গোটা বিশ্বজুড়ে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছিল। এক শ্রেণির মানুষকে জনসমক্ষে ‘নগ্ন’ হয়ে ঘোরার অভিযোগ আনা হয় সে সময়।

সেই ঘটনার মূল কারণ ছিল ঢাকাই মসলিন। সে সময়কার বেঙ্গল যা বর্তমানে বাংলাদেশ তার রাজধানী ঢাকা থেকেই এই কাপড়ের উৎপত্তি। সেই মসলিন এখন যেসব মসলিন দেখা যায় তার মতো নয়। ১৬ ধাপে বিস্তৃত প্রক্রিয়ায় বিশেষ সূতা দিয়ে তৈরি হতো সেই মসলিন। মেঘনার অববাহিকায় জন্ম নেওয়া সেই মসলিন ওই সময়কার গর্ব-সম্পদ বলে বিবেচিত হতো।

সেই মসলিনের ছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। প্রাচীনকাল থেকেই এর চাহিদা ছিল। গ্রিসের অনেক দেবীমূর্তিকে পরানো হতো ওই কাপড়। আর পরতো মুঘলসহ বেশ কিছু রাজপরিবারের সদস্যরা।

তবে মসলিনের ভেতরেও প্রকারভেদ ছিল। সবচেয়ে উন্নত মসলিন পৌঁছতো নানা রাজদরবারে। সে সময়কার রাজকবিরা সেই মসলিনের নাম দিয়েছিলেন ‘বোনা বাতাস’। সূক্ষ্ম বুননের ওসব মসলিন বাতাসের মতোই হালকা আর নরম ছিল।

এক পরিব্রাজকের ভাষায় সেসব শাড়ি একটাই মসৃণ আর হালকা ছিল যে ৩০০ ফুট কাপড় অনায়াসেই একটি আংটির ফাঁক গলে বেরিয়ে যেত। আরেকজন লিখেছেন, ৬০ ফুট লম্বা মসলিন কাপড় ছোট্ট একটা ম্যাচ বক্সের মধ্যেই ধরে যেত। আবার তা ছিল কাপড় হিসেবে স্বচ্ছের চেয়েও স্বচ্ছ।

মূলত জামা, শাড়ি এবং টিউনিক (রোমানদের বিশেষ পোষাক) জাতীয় পোশাক তৈরি করা হতো মসলিন কাপড় দিয়ে। শেমিস গাউনের ওপর এসব কাপড় পরা হতো। আর পোশাকগুলো এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে ভেতরে পরিধেয় সবকিছুই দেখা যেত বাইরে থেকে।

ব্যাঙ্গাত্মক এক প্রকাশনায় আইজ্যাক ক্রুকশ্যাঙ্ক লিখেছেন, কাপড়টি একটাই স্বচ্ছ ছিল যে একবার এক নারী সেটি পরে জনসমক্ষে আসার পর তার স্তন্যবৃন্তসহ গোপনাঙ্গের লোমও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সে সময়কার আরও এক মাসিক ইংরেজি পত্রিকায় বিদ্রুপ করে লেখা হয়েছিল, এই কাপড় পরা না পরা একই কথা। কেননা এই মসলিন আপনার শরীরের ওপর একটা স্বচ্ছ পর্দা মাত্র।

এত সমালোচনা-বিদ্রুপের পরও ঢাকাই মসলিনের চাহিদা ছিল আকাছোঁয়া। তবে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না এই কাপড়। কেননা এটি ছিল সে সময়কার সবচেয়ে দামী কাপড়। ফরাসি রানী মেরি অ্যান্টয়েনেট, ফরাসি সম্রাজ্ঞী জোসেফাইন বোনাপার্ট এবং জেন অসটেনের মতো বিখ্যাত লোকেরাও এই কাপড়ের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু যখনই এই কাপড় ইউরোপে জনপ্রিয় হতে শুরু করলো ঠিক তখনই ঢাকাই মসলিন যেন উবে গেল।

বিংশ শতকের শুরুর দিকের কথা। বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুর মসলিন। কেবল যারা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কিনেছিলেন তাদের সংগ্রহে আর কিছু যাদুঘরে টিকে রইলো ঐতিহাসিক মসলিন কাপড়। কারিগররাও ভুলে গেল মসলিন তৈরির কৌশল। বিশেষ যে জাতের তুলা থেকে সূতা তৈরি করে এই মসলিন বানানো হতো সেই বিশেষ জাতের তুলাও হারিয়ে গেল। স্থানীরা ওই তুলার জাতের নাম দিয়েছিল ফুটি কার্পাস। কিন্তু কেন অবহেলায় হারিয়ে গেল ফুটি কার্পাস? ওই বিশেষ জাতের তুলা কি সংরক্ষণ যেত না?

মেঘনার তীরে বেড়ে উঠতো ফুটি কার্পাস তুলোর গাছ। কেবল পূর্ণবয়স্ক একটি গাছ বছরে দুবার হলুদ ফুল দিত। সেই ফুল থেকেই মসলিনের কাঁচামাল (তুলা) পাওয়া যেত। এই তন্তু কোনো সাধারণ তন্তু নয়। কেননা ওই তুলা থেকে এতই সূক্ষ্ম আর প্রায় অদৃশ্য সূতা তৈরি হতো। অবাক করার মতো বিষয় হলেও ওই সূতা বুনেই তৈরি হতো মসলিন।

তাছাড়া এই সূতা দিয়ে মেশিনের সাহায্যে কোনো কাপড় তৈরি করা যেত না। পুরো কাজটাই করতে হতো সূক্ষ্ম হাতে। অন্যদিকে মসলিনে ব্যবহৃত সূতা বুনতে গেলেও খুব সাবধান থাকতে হতো। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু কারিগরই এই নিখুঁত কাজে জড়িত ছিল। বিশেষ এই কাপড় বানাতে কারিগর পরিবারের সব্বাইকে কমবেশি কাজ করতে হতো।

বিশেষ তন্তু দিয়ে তুলো তৈরির পর তুলোর বলগুলোকে স্থানীয় হ্রদে নিয়ে বোয়াল মাছের চোয়ালের উপরাংশের দাঁত দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। তারপর তা নৌকায় ফেলে কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া হতো। কারিগর পরিবারের তরুণীরাই এই কাজ করতেন। কেননা এই সূতা এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে বয়স্করা তা দেখতেই পেতেন না।

২০১২ সালে মসলিন নিয়ে প্রকাশিত এক বইয়ের লেখক সোনিয়া আশমোর বলেন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূতা একটার পর একটা জড়িয়ে তৈরি হতো মসলিন। মসলিন কাপড়ে খুব আরামদায়ক এক অনুভূতি রয়েছে যেটা কেবল গায়ে জড়ালেই অনুভব করা যায়।

আর মসলিনের বুনন ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। একেকটি মসলিন শাড়ি বুনতে প্রায় মাসখানেক পরিশ্রম করতে হতো একজন কারিগরকে। সেসব শাড়িতে আবার নানান ফুলের কারুকার্য করা থাকতো। এতটাই নিখুঁতভাবে এই কাজ করতে হতো যে, বুননের প্রতি মূহুর্তে মনোযোগী হতে হয় কারিগরকে।

বাংলাদেশের জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট রুবি গজনভি বলেছেন, মসলিনের পশ্চিমা ক্রেতারা বিশ্বাসই করতে চাইত না যে- এটি পুরোটাই হাতে তৈরি। তখন তো এমন কথাও চালু ছিল যে, মসলিন মানুষ নয় জলপরী,পরী কিংবা ভুতে তৈরি করেছে। সে যাই হোক- মসলিন এতটাই হালকা আর মোলায়েম ছিল যা আজকের দিনের কোনোকিছুতেই মিলবে না।

সেকালে সবকিছুই তো ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু হুট করেই এর উৎপাদন বন্ধে তৎপর হয় ব্রিটিশরা। তবে কিছু শাড়ি, স্কার্ভ কিংবা টিউনিকের মতো পোশাক এখনও টিকে আছে যাদুঘরে কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এ ছাড়া কালেভদ্রে ক্রিস্টিজ কিংবা বোনহামের মতো নিলামকারী প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকায় নিলামে বিক্রি করে থাকে এই কাপড়।

কিন্তু জগদ্বিখ্যাত এই কাপড়ের বাজার তৈরির পর তা নিজেরাই নষ্ট করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

মনে করা হয়, মোগল সাম্রাজ্যকাল থেকেই মসলিনের উৎপত্তি। ১৫২৬ সাল থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত পার্সিয়া (ইরান), ইরাক, তুর্কিসহ মধ্যপ্রাচ্যে এই কাপড়ের ব্যবসা ছিল রমরমা। তবে এই কাপড় সম্রাট পরিবারের সদস্যরাই ব্যবহার করতে পারত সে সময়। কেননা স্বচ্ছ এই কাপড় সবাইকে পরার অনুমতি দেওয়া হতো না। গল্প আছে, একবার মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা ৭ স্তরে মসলিন কাপড় পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন। তারপরো তার শরীরের প্রতিটি অংশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় মেয়েকে সাবার সামনে খুব বকাবকি করেছিলেন আওরঙ্গজেব।

এ পর্যন্ত তো সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। তারপর শুরু হলো ব্রিটিশ শাসন। ১৭৯৩ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো মোঘল সাম্রাজ্য জয় করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

তারপর থেকেই ব্রিটিশরা জগদ্বিখ্যাত এই কাপড়ের উৎপাদন রুখতে নগ্ন হস্তক্ষেপ শুরু করে। মসলিনের কারিগরদের ঋণের বোঝায় ডুবিয়ে আর্থিকভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।

প্রথমত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মসলিনের প্রকৃত গ্রাহকদের যাদের সঙ্গে মোঘল আমল থেকে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন তাতীরা সেসব গ্রাহকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরবর্তীতে তারা ঋণের বোঝায় তাঁতীদের কমদামে বেশি বেশি কাপড় উৎপাদনের মুখে ঠেলে দেয়।

পরবর্তীতে নানান ঘাত-প্রতিঘাতে পড়ে তাঁতীদের সেই জৌলুস হারিয়ে যায়। কেননা মাসের পর মাস পরিশ্রম করে মসলিন তৈরি করে তাদের কোনো কাজেই আসছিল না। বরং তারা আরও দেনায় ডুবে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে মসলিন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া ততদিনে ব্রিটিশরা কম খরচে উন্নত কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছে এদেশের কারিগরদের কাছ থেকে। সে প্রক্রিয়ায় নিজেদের দেশেই কাপড় উৎপাদন শুরু করে তারা।

এমনকি মসলিনের কৌশলও ছিনিয়ে নেয় ব্রিটিশরা। সেই কৌশল জানতে কারিগরদের ওপর দমন-নিপীড়নও করতেও পিছপা হয়নি খুনী ব্রিটিশরা। সেই চুরি করা কৌশল নিয়ে নিজেরাই মসলিন তৈরি শুরু করে ইংল্যান্ড। যদিও সেই মসলিন মানের দিক থেকে ঢাকাই মসলিনর আশপাশেও ছিল না।

তবুও কম দামে সেই মসলিন এই উপমহাদেশের কারিগরদের পেটে লাথি মেরেছিল। এরপর যুদ্ধ, দারিদ্র, ভূমিকম্পের কারণে উপহাদেশীয় কারিগররা বেঁচে থাকার দায়ে বাধ্য হয়ে কমদামী কাপড় বুনতে শুরু করে। এভাবেই কালের পরিক্রমায় কারিগরদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মসলিন থেকে দূরে থাকায় হারিয়ে যায় ঢাকাই মসলিন।

তবে আবার সেই মসলিন বানানো সুর উঠেছে ঢাকায়। এর শুরুটা হয় ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোনও কোনও এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

পরে নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ফুটি কার্পাস গাছ আর মসলিনর নমুনা খুঁজে পান গবেষকরা। তবে মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না। এখন ভারতেও মসলিন তৈরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই আলাদা।

তাই তো ঢাকাই মসলিন তৈরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন একদল গবেষক। তাদেরই ছয় বছরের চেষ্টা আর গবেষণা ফল দিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে মসলিনের ছয়টি শাড়ি। মসলিন বোনার সুতা যেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয়, সেই গাছ খুঁজে বের করা হয়েছে বিচিত্র সব পন্থা অবলম্বন করে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এই শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের হাতে কাটা ৫০০ কাউন্টের সুতাই ব্যবহার করতে হয়েছে। কাপড়ও বোনা হয়েছে হস্তচালিত তাঁতেই।

হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন বর্তমান প্রজন্ম ফের ঐতিহাসিক যুগের সবচেয়ে দামী মসলিন কাপড় ফিরে পাবে। 

আর সি