জাপানে বাংলাদেশি গবেষক ড. শাকিরুল খান শাকিল'র গবেষনায় জলাতঙ্ক চিকিৎসা ব্যবস্থাতে নতুন আশার আলো দেখা দিচ্ছে এমনটাই মনে করছেন গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আকিরা নিশিজনো। তিনি বলেন, গবেষণায় প্রাপ্ত এ ফল ‘অত্যন্ত চমকপ্রদ’।
সম্প্রতি জাপানের ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশি বংশোভূত ড. শাকিল জলাতঙ্ক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে এক গবেষনার সাফল্যে নিশিজনো এমন মন্তব্য করেন।
ঔইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ফেভিপিরাভির (এভিগান নামেও পরিচিত) নামক অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ মুখে খাইয়ে কিংবা ক্ষতস্থানে অয়েন্টমেন্ট (মলম) হিসেবে লাগিয়ে আরআইজির বিকল্প হিসেবে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ব্যবহার করলে শতভাগ ইঁদুর জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাচ্ছে। পাশাপাশি ফেভিপিরাভির প্রাপ্ত ইঁদুর আরআইজি প্রাপ্ত ইঁদুরের তুলনায় অনেক বেশি ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করছে, যা রেবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির ইঙ্গিত বহন করে।
এ সম্পর্কে নিশিজনো বলেন, ফেভিপিরাভির আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস (এফডিএ) অনুমোদিত একটি ওষুধ, যা বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি এবং মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই ফেভিপিরাভির ওষুধটির নিরাপত্তা মানুষের শরীরে নতুন করে পরীক্ষার দরকার হবে না। এখন প্রয়োজন শুধু জলাতঙ্ক রোগের ক্ষেত্রে যথাযথ ক্লিনিক্যাল স্টাডি সম্পন্ন করে ইঁদুরে প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা।
গবেষণাটির অন্যতম লিড গবেষক এবং ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ফ্যাকাল্টি ড. শাকিল জানান, গবেষণার ফলটি জলাতঙ্কের চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত। এতদিন পর্যন্ত প্রচলিত ধারণা ছিল, রেবিস ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রে (স্পাইনাল কর্ড কিংবা মস্তিষ্কে) প্রবেশ করলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতভাগ নেই বললেই চলে। কিন্তু আমরা জীবন্ত ইঁদুরে রেবিস ভাইরাসের মুভমেন্ট ট্র্যাকিং করে দেখতে পেয়েছি, রেবিস ভাইরাস স্পাইনাল কর্ড কিংবা মস্তিষ্কে প্রবেশ করার পরও যেসব ইঁদুরকে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ফেভিপিরাভির দ্বারা চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, সেই ইঁদুরগুলো পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, ফেভিপিরাভির এমন একটি অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ, যেটি রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিনের (আরআইজি) কার্যকরী বিকল্প হিসেবে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ব্যবহার করে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে।
গবেষণার ফলাফল ইঁদুরের ওপর পরীক্ষিত, যা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা, তা এখনো যথাযথ ক্লিনিক্যাল স্টাডি দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। এমতাবস্থায় ক্লিনিক্যাল স্টাডির ফলাফল পাওয়ার আগে কেউ যেন নিজ উদ্যোগে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসায় ফেভিপিরাভির ব্যবহার না করেন বলেও এ সময় তিনি উল্লেখ করেন।
এ সময় ড. শাকিল আরো বলেন, তিনি বাংলাদেশে মানবদেহে একটি কার্যকরী ক্লিনিক্যাল স্টাডি করতে চান। এ ক্ষেত্রে সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ফেভিপিরাভির ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, জলাতঙ্ক রোগটি হাইড্রোফোবিয়া নামেও পরিচিত। যা এক ধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস থেকে সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাস সাধারণত গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণীদের প্রথমে সংক্রমিত করে। কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বাদুর, বেজি, বানর ইত্যাদি প্রাণী জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত প্রাণীটি সুস্থ মানুষ বা গবাদি পশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে এবং কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তির ৪০ শতাংশই ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। আক্রান্ত ব্যক্তির জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগে যথাযথ চিকিৎসা পোস্ট এক্সপোজার প্রোফাইলেক্সিস (পিইপি) [যার মধ্যে রয়েছে রেবিস ভ্যাকসিন এবং রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (আরআইজি)] দেওয়া না হলে ওই রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতভাগ নেই বললেই চলে।
বর্তমানে রেবিসের কার্যকরী পিইপি বিদ্যমান থাকলেও বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতিবছর ৫৯ হাজারের বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যাচ্ছেন। এই মৃত্যুর ৯০ শতাংশের বেশি এশিয়া এবং আফ্রিকার নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইউএইচও) প্রদত্ত নির্দেশিকা অনুসারে, তৃতীয় ক্যাটাগরির ইনজুরির (এক বা একাধিক কামড়সহ প্রাণীর নখের আঁচড় দ্বারা আক্রান্ত) ক্ষেত্রে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে আরআইজির প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু আরআইজির উচ্চমূল্য এবং অপর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য বেশিরভাগ নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রচুর সংখ্যক তৃতীয় ক্যাটাগরির ইনজুরির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত নির্দেশিকা অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জলাতঙ্কে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করাও সম্ভব হচ্ছে না
আর এ