২৮ এপ্রিল জাতীয় আইন সহায়তা দিবস। আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির অধিকার মূলত একটি সাংবিধানিক অধিকার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল সংবিধানেই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারসহ বিচার প্রক্রিয়ায় ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার বিধান সন্নিবেশিত করে দেন। সংবিধানে স্পষ্টভাবে সন্নিবেশ করা হয় সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে (অনুচ্ছেদ- ১৯.১)। প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ- ২৭)। কোন ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ- ৩৩.১)। প্রত্যেক নাগরিকের দ্রুত বিচার লাভের অধিকার থাকবে (অনুচ্ছেদ- ৩৫.৩)। সংবিধানে এসব বিধান অর্ন্তভুক্তির মধ্য দিয়ে ধনী বা আর্থিক সামর্থবান নাগরিকদের পাশাপাশি দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হলেও স্বাধীনতার পরবর্তী তিন দশকে দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারে আইনগত সহায়তা প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক কোন কাঠামো চালু হতে দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার সরকার গঠন করেই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল,সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচার প্রার্থী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করার লক্ষে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০' প্রণয়ন করে দেন এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ আইনের বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করলে আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে ঢাকার বেইলি রোডে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় এবং এর অধীনে প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনসহ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, চৌকি আদালত এবং শ্রম আদালতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম চালু করা হয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এমনকি সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্টেও লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সারাদেশে সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এজন্য দেশের সব চৌকি আদালত এবং ঢাকা ও চট্রগাম শ্রম আদালতেও বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে এখন শুধু আইনি সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে এ অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এজন্য ২০১৫ সালে “আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি” বিধিমালা প্রণয়ন করে লিগ্যাল এইড অফিসারদেরকে এডিআর বা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির আইনি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষমতাকে আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার লক্ষে ২০১৭ সালে দেওয়ানি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজকে লিগাল এইড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তারা আইনগত সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে ডিজিটাইজেশন করা হয়। এ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করা হয় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার ১৬৪৩০। টোল ফ্রি এ নম্বরে ফোন করে যে কেউ আইনি পরামর্শ নিতে পারেন। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় লিগ্যাল এইড সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে চালু করা হয় লিগ্যাল এইড অনলাইন কার্যক্রম।লিগ্যাল এইড অফিস থেকে যে সব আইনি সেবা প্রদান করা হয় : (১)যে কোন ব্যক্তি, তার আর্থিক সামর্থ্য যাই হোক না কেন, সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত আইনগত তথ্য সেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিবাদমান পক্ষসমূহের মধ্যে আপোষযোগ্য বিরোধসমূহ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সেবাসমূহ ; (২) অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা দায়েরের প্রয়োজন হলে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও পরিচালনা করা; (৩) মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ; ৪) আদালত থেকে প্রেরিত মামলাসমূহ মধ্যস্থতা করা; (৫) বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ; (৬) আইনজীবীর ফি পরিশোধ; (৭) মামলার সাথে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সকল ব্যয় পরিশোধ; (৮) ফৌজদারী মামলার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ; (৯) মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানী পরিশোধ; (১০) ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ; (১১) বিনামূল্যে রায় কিংবা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ।
যারা আইনগত সহায়তা পাবেন : (১) অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যাহার বার্ষিক গড় আয় সুপ্রীম কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ১,৫০,০০০/- টাকা এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে ১,০০,০০০/- টাকার ঊর্ধ্বে নয়; (২) কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক ১,৫০,০০০/- টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা; (৩) কোন শ্রমিক যার বার্ষিক গড় আয় ১,০০,০০০/- টাকার ঊর্ধ্বে নয়; (৪) কোন শিশু; (৫) মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি; (৬) শারীরিক নির্য়াতন, মানসিক নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু; (৭) নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে; (৮) কোন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের লোক; (৯) পারিবারিক সহিংসতার শিকার অথবা সহিংসতার ঝুঁকিতে আছেন এরূপ যে কোন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি; (১০) বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এরূপ কোন ব্যক্তি; (১১) ভিজিডি কার্ডধারী দুঃস্থ মাতা; (১২) দুর্বৃত্ত দ্বারা এসিড দগ্ধ নারী বা শিশু; (১৩) আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্ত ব্যক্তি; (১৪) অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুঃস্থ মহিলা; (১৫) কোন প্রতিবন্ধী; (১৬) আর্থিক অসচ্ছলতার দরুণ আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে অসমর্থ ব্যক্তি; (১৭) বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল; (১৮) আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি; (১৯) জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল হিসেবে সুপারিশকৃত ব্যক্তি।
কোথা থেকে ও কিভাবে আইনি সেবা পাওয়া যায় : (ক) জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার থেকে : আইনি সেবা প্রদান আরও বিস্তৃত ও সহজ করার লক্ষ্যে সরকার ২০১৬ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার চালু করেছে। অফিস চলাকালীন এই কল সেন্টারের ১৬৪৩০ নম্বরে যে কোন মোবাইল/টেলিফোন থেকে ফোন কল করে আইনি পরামর্শ, আইনগত তথ্য, লিগ্যাল কাউন্সিলিং, মামলা/মোকদ্দমা করার প্রাথমিক তথ্য, সরকারি আইসি সেবা সম্পর্কিত যে কোন পরামর্শ, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কোন অভিযোগ কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ সম্পর্কিত সেবা পাওয়া যায় । এর জন্য কোন কলচার্জ কাটা যায় না। (খ) লিগ্যাল এইড অফিস থেকে : জেলা পর্যায়ের মামলা পরিচালনায় আইনগত সহায়তা লাভের জন্য ৬৪টি জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থিত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির নিকট আবেদন করতে হয়। সুপ্রিম কোর্টে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস’ এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির নিকট আবেদন করতে হয়। ঢাকা ও চট্রগ্রাম শ্রম আদালতে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সেখানকার শ্রমিক আইন সহায়তা সেল এর মাধ্যমে শ্রম আদালত বিশেষ কমিটির নিকট আবেদন করতে হয়। চৌকি আদালতে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট চৌকি আদালত বিশেষ কমিটির নিকট আবেদন করতে হয়। (গ) বিডি লিগ্যাল এইড এ্যাপ-এর সহায়তায়: অনলাইনে আইনি সেবা প্রদানের লক্ষে সরকার ২০১৮ সালে বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপ চালু করেছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে এই এ্যাপটি ডাউনলোড করে যে কেউ অনলাইনে তার আইনগত সমস্যার কথা জানাতে এবং আইনি পরামর্শ পেতে পারেন।
এছাড়া [email protected] ই-মেইল ঠিকানায় এবং bdnlaso ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যেতে পারে। বিদেশ থেকে +৮৮০৯১২৩১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যাবে।
আইনি সেবার আবেদনপত্র প্রাপ্তিস্থান: সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা লাভের জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নির্ধারিত আবেদন ফর্মে আবেদন করতে হয়। এই আবেদনপত্র প্রতিটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্রগ্রাম শ্রমিক আইন সহায়তা সেল, চৌকি আদালত প্রাঙ্গন এবং www.nlaso.gov.bd ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
আবেদনপত্র দাখিল করার প্রক্রিয়া: দরখাস্তকারী নিজে বা তার মামলা তদারককারী বা তদবিরকারী সংশ্লিষ্ট জেলার লিগ্যাল এইড অফিসে সরাসরি আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন বা দাখিল করতে পারেন। তাছাড়া কারা কর্তৃপক্ষ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিশনার, সমাজসেবা কর্মকর্তা বা বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও আইনগত সহায়তার আবেদনপত্র লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠানো যায়। এক্ষেত্রে আবেদনপত্র জমাদান সহ যে কোন প্রয়োজনে উক্ত অফিসের সহায়ক কর্মকর্তা অথবা অফিস সহকারীর সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক: গবেষক ড. মো. রেজাউল করিম
আর সি