- শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

ছোটগল্প

অন্তহীন

ঈশানা

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১৫ এপ্রিল ২০২২

অন্তহীন

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির জানালায় জমা তিরতির করা বিন্দুবিন্দু পানির আড়ালে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে চোখ পড়লেও, চোখ থেকে মস্তিষ্কে সিগন্যাল যেতে অনেকটা সময় নিলো যে বালিকা বা ঠিক করে বললে, ওই ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রী বর্ষা। ওর অফিস আশেপাশেই। কাজেই ছুটির সময় ওর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অফিস থেকে পাওয়া আমার গাড়িতে আমি একাই আছি, চাইলেই ওকে ডেকে নেওয়া যায়। কিন্তু চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না, অন্তত আমাদের মাঝের সেই সম্পর্ক হারিয়ে গেছে। তাই তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জ্যাম ঠেলে ভুশ করে আমার গাড়িটা সামনে চলে গেল। ওড়না দিয়ে ঘাম মুছতে চাওয়া বালিকাকে আমার আর ডেকে নেওয়া হলো না।

বর্ষা আর আমার প্রেম বলা যায় বাল্য প্রেম। আমি ছিলাম একদম লাফাঙ্গা ছেলে, তবে বখাটে না। একেবারে টায় টায় পাশ করা, দুপুর বিকাল খেলাধূলা করে শ্যামলা চামড়া তামাটে বানানো, মায়ের বিশাল বিশাল দীর্ঘশ্বাস আর রাতদুপুরে চাপা ঝগড়ার কারণ হওয়া ছেলে। অর্থ বিত্ত ছিল বাবার, কাজেই না খেয়ে মরবো না। সেই বিশ্বাসে পড়ালেখা ছাড়া সবই করে বেড়াতাম।

 সেই আমি ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে স্কুলের লাগোয়া বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম। ভালো খেলোয়াড়ই ছিলাম বেশ। কাঠের হালকা রংচটা বলটার লক্ষ্য ছিল  মাঠ পার হওয়ার, কক্ষচ্যুত হয়ে আঘাত হানলো স্কুলড্রেস পরা বালিকার কপালে। মৃদু উহঃ করে বালিকা ভূপাতিত হলো, আর রক্তের পটভূমিতে তার শুভ্র মুখখানা দেখে আমার ইহকাল পরকাল আসমান জমিন এক হয়ে গেল।

ডাক্তারখানা নেওয়া, ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় কিভাবে পার হলো এত মনে নাই, কিন্তু ছোট শহরের সুবিধা যেটা.... বালিকার ঠিকুজি কুষ্ঠি জোগাড় হয়েই গেল।

সরকারি হাসপাতালের নতুন ডাক্তার সাহেবের আদরের ছোট মেয়ে, তায় ভালো ছাত্রী। বন্ধুরা কানপরা দিলো, আশা নাই কোনো... পিছু হটে যা। আমি বরাবরই জেদী মানুষ। শুনলাম না। আমার দিনের হয়ে গেল দুই ভাগ। এক ভাগে আমি প্রথমবারের মত মাধ্যমিকের বই ছুঁয়ে দেখলাম, অথবা পড়াশোনাকে জয় করা শুরু করলাম। আরেক ভাগে এইটে পড়ুয়া সদ্য কিশোরীর পেছনে ছায়ার মত ঘুরতে লাগলাম। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের লেগে গেল ত্রাস, মায়ের মুখে হাসি ফুটলো। কিন্তু বালিকা জানলো না বালকের হৃদয়ের কথা। ওইটুকু বয়সেও আমার এইটুকু আক্কেল ছিল যে এইটে পড়া মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া খুবই অন্যায়।

সেই প্রস্তাব দিলাম মফস্বল ছেড়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে। বালিকার চোখের পাতাটুকুও নাচলো না, এতটুকুও না।আমার তাতে সত্যিই কিছু যায় আসে না। এলাকার কিশোর তরুণ এখন সবাই জানে বর্ষা আমার, বাকি সাত আসমান উপরের একজনের উপরে ভরসা রাখলাম।

বালিকার হৃদয়ের পাথর গলে গেল, বা গলেই ছিল... সেই পাথর সেঁচা জলের উষ্ণ  ছোঁয়া টের পেলাম হঠাৎ করে। আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলাকালীন মা মারা গেল। কেউ আমাকে জানালো না, আমি ব্যবহারিক শেষ করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে দেখি আঙিনার এক কোণায় মায়ের ছোট্ট স্থায়ী বাসা। এক ধাক্কায় বাসার সব কাঁচের জিনিস চুরচুর করে ফেললাম। ছোট এলাকা, সবাই জেনে গেল সিদ্দিক সাহেবের ছেলে "পাগলায় গেসে"।

সেই সময়ে বালিকা ধরা দিল। সম্ভবত কথাটা "ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা সব শিশুরই অন্তরে" হলে ঠিক হতো! তখনও নাবালিকা মেয়েটা আমার সম্পূর্ণ দায়ভার নিজের করে নিলো। ভালোবাসা থেকে না মমতা থেকে জানি না।তখন জানার মত মানসিক স্থিতি ছিল না আমার। ওকে নিজের করে পেলাম, ওই সময়ে জীবনে একমাত্র আশার আলো ওইটুকুই।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে সম্পর্কটা ভালোই চলছিল। আমি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষে আর বর্ষা মাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, তখনই ভাবী শ্বশুরমশাই এর স্ট্রোক হলো। মানুষের শরীর খারাপ হলে মনে নানান চিন্তা জ্বলে উঠে। তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে গেল বর্ষার বিয়ে। 

আমার কথা বলা লাগলোই ওর বাসায়। তাতে বর্ষার ডাক্তার পিতা আর এফ এল এর অটো চুলার মত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কারণ ততদিনে আমার পিতাশ্রী আরেক বিয়ে সমাধা করে জোড়া কন্যার পিতা হবার সৌভাগ্য লাভের সাথে সাথে বৃদ্ধ বয়সে দুই কোলে দুই কন্যা নিয়ে ঘুরে এলাকায় এক বিশেষ সং চরিত্র হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছেন। সৎ মা ডাইনী ও না, আবার শাবানা ও না। মধ্যবয়সে সংসার স্বামী আর সন্তান পেয়ে সন্তুষ্ট একজন মানুষ। আমি বাড়ি গেলে কিছুটা দেবর দেবর ধরণের আহ্লাদী আপ্যায়ন করেন আর কী!

 তাকেই বললাম আর কী মনের কথা। তিনি কতটুকু বুঝলেন বা তার স্বামীকে কতটুকু বুঝালেন জানি না, ঘরের দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল আমার জন্যে।

স্টেশনে বসে সদ্য সাবালিকা প্রেমিকাকে ফোন দিলাম।তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, " তুমি কোথায়?"। উত্তর শুনে ফোন কেটে দিলো। দশ মিনিটের মধ্যে প্রমাণ সাইজের একটা স্যুটকেস বয়ে সে হাজির। আমিও চুপচাপ আরেকটা টিকেট কেটে আনলাম।

পরদিন বিয়ে করে সাবলেট বাসা খুঁজে নিলাম। হলে থাকার প্রশ্নই উঠে না। জীবনের সবটুকু দিয়ে যাকে চেয়েছি, পেয়েছি। আর কোনো কিছুর ধার ধারার সময় কই আমার?  টিউশনি ছিল আগের, আরো দুটো নিলাম। কাজেই পথে বসলাম না বা না খেয়ে রইলাম না। অবাক কাণ্ড, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী তথা জোড়া কন্যার মাতা, তার ভাইয়ের হাতে হাজার দশেক টাকা আর আমার বউ এর জন্যে শাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। জুতো মেরে গরু বা গরু মেরে জুতা, কিছু একটা দান হবে। অত ভাবতে যাইনি।

পাশ করলাম। চাকরি পেলাম। জীবন কতটা সুন্দর ছিল, তার কোনো বিশেষণ আজ আর জানা নেই। প্রতিটা সকাল স্বপ্নের মত, প্রতিটা রাত কবিতার মত। বর্ষা গৃহিণী হবার চেষ্টা করেনি, আমিও মনে প্রাণে ওকে বালিকাই দেখতে চেয়েছি। ওভাবেই ছিলাম অনেকদিন।

বউ চাকরি পেল। তাতে আমাদের জীবন কিছু পাল্টালো না। তবে মহামহিমের কৃপা বোঝার সাধ্য কী? হুট করেই পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই আমাদের জীবনে "বাবুই"কে পাঠালেন। আমাদের মেয়ে। জীবন পাল্টে গেল ১৮০ ডিগ্রিতে। বালিকা হয়ে উঠলো পক্ষিমাতা।

সুখ থৈথৈ জীবনে কোথাও না কোথাও তো গরল থাকারই ছিল। আমার দেড় বছরের মেয়ে ঘুমের মধ্যে মরে গেল। বেমালুম নাই হয়ে গেল। মেয়ে আমাকে "আবা" ডাকতো, আর মা কে " আমি"। ছুটির দিনে দুইপাশে তার আবা আর আমি ঘুমিয়ে ছিল, কিভাবে যেন স্বর্গের পাখি ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। একদম কিছু বুঝতে পারিনি। না আমরা, না ডাক্তার। ঠোঁটের কোলে রক্তের ক্ষীণ ধারা নিয়ে চলেই গেল সে।

যে মেয়েকে চোখের আড়াল করেনি তার মা, স্বেচ্ছায়  চাকরি ছেড়ে বসে ছিল, সে মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে পেলো না। চিকিৎসকের নির্দেশে কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলাম তাকে।এইটুকু একটা পাখির পালকের মত মানুষ, ওজন ছিল সাড়ে এগারো কেজি। তাকে কবরে নামাতে গিয়ে আমার মনে হলো, দুনিয়ার সব ভার আমার কাঁধে। আমি হাঁটতে পারি না, দাঁড়াতেও পারি না সে ভারে। এত আদরের, এত আকাঙ্খার যে পাখিটা.. তাকে নামিয়ে এলাম অঝোর বৃষ্টির মাঝে অচেনা এক রাজ্যের পথে একলা। 

স্বর্গের ফুল স্বর্গে চলে গেল তার সুরভী নিয়ে, পেছনে ফেলে গেল এক জীবন্মৃত বাবা আর বাকরুদ্ধ মা কে। আমাদের আশেপাশে মানুষের অভাব নেই আর আগের মত। মেয়ে আমাদের ছেড়ে গিয়ে আগের সব স্বজনকে কাছে নিয়ে এসেছে। যারা সুখে ছিল না, দুঃখে ব্যথিত হয়ে তারা এগিয়ে এসেছিল। সবার মুখে তখন একই লবজ, বাচ্চা মরার কতদিনের মাথায় কার কত দ্রুত আরেকটা বাচ্চা হয়েছে। ভালো চেয়েই বলতো, হয়তোবা, কিন্তু আমার বুক চিড়ে যেত। জানি না, বর্ষার ও। হয়তো। আমাদের মধ্যে তো আর কথা হয় না। তাই আমি জানি না ওর কেমন লাগে। কেন, কিসের জন্যে জানি না... বালিকা আমার থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। খুব সম্ভব মেয়েকে শেষ দেখা না দেখতে দেবার অপরাধে। ওর চোখের দৃষ্টি বারবার বলে," ডাক্তার তো আমার কেউ না। ডাক্তার যা ইচ্ছা বলুক। তুমি কিভাবে এটা হতে দিলে? কিভাবে আমাকে না দেখিয়ে আমার মেয়ে নিয়ে গেলে?"। একসময় চোখে চোখ রেখে কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। বাবুই পাখি আর বালিকাকে হারিয়ে আমি সর্বহারা হয়ে গেলাম।

বালিকা আর আমার বালিকা রইলো না। কেবলই হারিয়ে যাওয়া বাবুই পাখির মা বর্ষা হয়ে গেল। আবার চাকরিতে ঢুকে গেল। দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হয়ে রইলাম আমরা, এমনকি খাবার সময়ও দেখা হয় না আমাদের।  

একদিন আমার রুমে উঁকি দিল। মৃগনাভির সুবাস কেমন হয় আমার জানা নেই। কিন্তু তিরতির  করে অজানা সুবাস ভেসে এল। বালিকা কি ধরা দিল আবার? কিন্তু না। তার বলার ছিল অন্য কিছু। সে অফিসের কাজে দূরে যাচ্ছে দিন পনেরোর জন্যে। ফিরে এসে কর্মজীবী হোস্টেলে উঠবে। এইটুকুই তার বলার ছিল। দমচাপা আবেগকে মথিত করে আমি কেবল এক কথায় "আচ্ছা" বলে বিরাম চিহ্ন টেনে দিলাম। তাও মাস তিনেক হয়ে গেল।

পুরনো কথা ভাবতে চাই না চাই না করেও মনে পড়ে যায় আর মেজাজ খিচড়ে যায়। বিয়ের পরে যে বন্ধুদের আড্ডা ভুলে গিয়েছিলাম, এই কয় মাস ধরে নিয়মিত যোগদান করছি। দরকার হলে অঢেল টাকা ঢেলে সবাইকে টেনে আনছি নিজেই। আমার সন্ধ্যা, আমার রাতটুকু তো কাটাতে হবে।আর কতটা ভুলে থাকা যায়? যতটা ভুলে থাকার চেষ্টা করা যায়।

আজ আর জমলো না আড্ডা। আমিই রণে ভঙ্গ দিয়ে উঠে গেলাম। ভালো লাগছে না। ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছি আগেই। গাড়ি নিয়ে এলোমেলো উদ্ভ্রান্ত দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চুম্বকের মত আকর্ষণ চলে যাচ্ছে একদিকে, কিন্তু নিজেই সেটাকে অস্বীকার করে এদিকসেদিক যাচ্ছি। শেষমেষ গাড়ি গিয়ে ভিড়লো বর্ষার বড় বোন চৈতী আপার বাসায়।

 চৈতী আপা আমার মোটেও পছন্দের মানুষ না। টিচার মানুষ, খালি জ্ঞান দান করেন। কিন্তু তিনি আজ মায়ের কাজ করলেন।আমার একটা কথা বলা লাগল না। কিছু না জিজ্ঞাসা করে, কিছু না জানিয়েই বর্ষাকে ডাকলেন। ঠিক আগের মত, বাসার নিচে অপেক্ষা করছিলাম বালিকার। এলো। একরাশ ক্লান্তি আর শ্রান্তিও সেই মুখের লাবণ্য এক চুল কমাতে পারেনি। রিকশা থেকে নেমে আমাকে দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।

যে বালিকাকে পেতে এতটা কাঠখড় পুড়িয়েছি, তাকে এত সহজে কী করে যেতে দিই আমি? সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, তার বিনিময়ে আমি যদি মুখ ঘুরিয়ে নিই তবে কিসের আর ভালোবাসা আমার?

কত কী বলবো ভেবেছিলাম, কিছু বলা হলো না। বলা লাগলো ই না। হঠাৎ আসা ঝোড়ো বর্ষার হাওয়ায় রেশমের মত অসভ্য চুলগুলো ওর মুখ ছেয়ে দিল। আঙুল দিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিতে গেল, হাত ধরে ফেললাম আমি। কী ভীষণ উষ্ণ সে হাত, যেন  আগ্নেয়গিরির আড়াল লুকিয়ে রেখেছে!মুখের দিকে চাইলাম। ডাগর চোখগুলোতে যেন শত বর্ষার জল থৈথৈ করছে! এই তো, আমার বালিকা! এই পুরো নশ্বর অবিনশ্বর সকল সৃষ্টির মাঝে বিধাতা শুধু আমার জন্যেই তাকে বরাদ্দ করেছেন, আমি নিশ্চিত জানি।

কেবল বললাম, "যাবে?"
কোথায়, কেন সকল প্রশ্ন উহ্য রেখে স্থির চোখে তাকিয়ে অচঞ্চল স্বরে বললো,"চলো।"

শান্ত পায়ে হাতে হাত ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কথা হলো না, বলা লাগলো না। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে দিয়ে আমরা হেঁটে চলে গেলাম অনেকটা পথ। 

এরপর কী হবে জানি না। ভবিষ্যত ভেবে কোন কাজটাই বা করেছি জীবনে? তবে বালিকার হাত ছাড়বো না আর। আর কিছু জানি আর না জানি.... এই হাত ছাড়ার জন্যে ধরিনি,এইটুকু ঠিক জানি ।

আর এ