- সোমবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ১৬ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম

পি আর প্ল্যাসিড

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১২ নভেম্বর ২০২১

আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম

কি বলতে কি বলেছিলাম সেটা এখন আর আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে মেয়েটিকে প্রথম দেখাতে-ই ওকে বলেছিলাম, তুমি অনেক সুন্দরী। তোমাকে দেখতে আমার কাছে অনেক ভালো লাগছে।
একথা বলার পর মেয়েটি আমার সামনে একদম পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি ওর এমন মূর্তির রূপ দেখে মনে মনে ভয় পেয়েছিলাম; আবার কিনা আমাকে ধমক দিয়ে বলে, আপনাকে আমি অনেক ভালো মনে করেছিলাম। আপনি এমন অসভ্যের মতো কথা বলবেন, তা বুঝতে পারিনি। 

আজকাল মেয়েদের প্রপোজ করলে এমন করেই ছেলেদের অপমান করতে পছন্দ করে। কারণ হিসেবে জেনেছি-মেয়েদের সবারই নাকি স্কুল জীবন থেকে কারো না কারো সাথে সম্পর্ক থাকে, তাই।
যখন দেখলাম মেয়েটি কোন কথা না বললেও একটু লাজুক লাজুক ভাব করছে তখন সাহস করে আবার বললাম, 'তোমার চোখ দুটি কিন্তু ঠিক নাটোরের বনলতা সেন'র মতো। একথা বলার সাথে সাথে মেয়েটি উল্টো আমাকে প্রশ্ন করেছিল, - আপনি কি তাকে কখনো দেখেছেন?'

একথা বলার পর আমি আর যাই কোথায়? সত্যিইতো আমি কখনো দেখিনি। তাহলে? তাহলে কিভাবে তাকে আমি নাটোরের বনলতা সেন'র সাথে তুলনা করলাম? এমনকি মেয়েটির বাড়ি যে নাটোর সে কথাও আমার জানা ছিল না। আমি ওর কথার পর সাহস সঞ্চয় করে আবার বললাম, আমাকে সব দেখতে হবে কেন? আমাদের কবি জীবনান্দ দাস দেখেছেন না? তবেই তো হয়েছে। কবি কি আর বনলতাকে না দেখে একটি মেয়ে সম্পর্কে তার রূপের এমন ব্যাখ্যা করতে পারেন?
মেয়েটি তখন বলেছিলো, আমার বাড়ি নাটোর জেলায়। আমি তো কোনদিন শুনিনি 'বনলতা সেন বলে বাস্তবে নাটোর জেলায় কেউ ছিলো। কেউ কোনোদিন তার অস্থিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তাও জানি না। এসবই কবির ভাবুক মনের কল্পনা মাত্র।'

তাহলে তো আজ থেকে আমি আপনাকে বনলতা সেন নামেই ডাকবো।
আপনি কেন আমাকে এই নামে ডাকবেন? আমার তো একটা নাম রয়েছে, যা আমার বাবা-মা জন্মের পর রেখেছেন। তাছাড়া আপনি তো আর কবিতা লেখেন না যে, আমাকে নিয়ে আপনি কবিতা লিখবেন।

তারপরই বললাম, আমি আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিই আগে। যেহেতু আপনি বলছেন যে, এই নামে কেউ ছিলো না, তাই, আমি-ই না হয় বাস্তবে কোনো একজনকে দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে এই নামে ডাকবো? আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমাদের দেশে কেউ কবি হয়ে জন্ম নেন না। কবি হন প্রেমে পড়লে, না হয় প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে, আর তারপরই কবিতা লিখতে শুরু করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই সত্য।

মেয়েটি নিজেই তার পরিচয় দিতে গিয়ে নাম বলেছিলো এভাবে- আমার নাম লরেটো, পুরো নাম লরেটো গমেজ। এ'বছর আমি নার্সিং কোর্স সম্পন্ন করে ঢাকা মেডিক্যালে জয়েন করেছি।
লরেটো নামটি আমার কাছে নতুন ছিলো না। তবুও কথা বাড়ানোর প্রবণতা নিয়ে বলেছিলাম-বাহ! বেশ সুন্দর নাম; কে রেখেছিলেন আপনার এই নামটি? আপনার চেহারার সাথে এই নামটি মানিয়েছে বেশ। বলতেই মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে লরেটো বলল, আপনি তো বেশ।
 
কেন? আমি আবার কি করলাম এখন আপনার সাথে?
 বলছি, তবে আমাকে আপনি করে বলার চেয়ে তুমি করে বলতে পারেন। আপনি আমার বয়সে বড়।

বয়স দিয়ে কি কারো সাথে কারো প্রেম ভালোবাসা হয়? সম্বোধন, সেটা কথা বলতে বলতে ঠিক হয়ে যাবার বিষয়। আমাদের তো কেবল পরিচয় হলো। সামনে যদি আবার কখনো দেখা হয় বা কথা হয় তবেই না বলা যাবে আপনাকে আমি তুমি বলবো নাকি আপনি করেই সম্বোধন করবো।

সেই যে কথা হয়েছিল এরপর লরেটোর সাথে আমার অনেক গুলো বছর আর কোনো দেখা হয়নি। কথা বলা দূরের কথা।
অনেকদিন পর........
একবার কোন এক কাজে আমি গিয়েছিলাম নাটোর জেলার চাট মোহর এলাকার বর্নী মিশনে। বর্নী মিশনে কোন এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিলো। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সচরাচর আমি যাই না। তারপরেও যাওয়াটা ছিলো আমার ঢাকা শহর থেকে দূরে কোথাও গিয়ে ব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে একটু সময় কাটানোর জন্য। গিয়েছিলাম সেখানকারই স্থানীয় এক বন্ধুর সাথে। বন্ধুটি কাজ করে ঢাকায় অবস্থিত একটি এনজিও অফিসে। ছাত্র জীবন থেকেই তার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। যে কারণে সে তার এলাকার অনুষ্ঠানে যাবার আগে আমাকে সৌজন্যতা রক্ষার্থে এমনিতেই জানতে চেয়েছিলো আমি যাবো কিনা তার সাথে। আর অমনি আমি রাজী হয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ যাবো।

যেহেতু ঢাকা থেকে নাটোর দূরের পথ তাই আগের দিন সকাল বেলা আমরা ঢাকা থেকে বাসে রওনা দেই। রাতে যেন তাদের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে পরেরদিন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে পারি। নাটোর সম্পর্কে আমার আগে তেমন কোনো বাড়তি ধারনা ছিলো না। যে কারণে নাটোর বলতে আমার মাথায় সর্বদা খ্যাতিমান কবির সেই কবিতার লাইনটাই মনে পড়ছিলো। "নাটোরের বনলতা সেন"। এমনকি নাটোর যাবার আগেও আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম লরেটোর কথা আর তার বাড়ি যে নাটোরে সেই কথা।

পরিচয়ের পর কয়েক বছরতো কেটে গেলো। জীবনে চলার পথে দৈনিক কতো জনের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, কতো জনকে আর মনে রাখা যায়?
যাত্রা পথে আমি আমার সেই বন্ধুকে বারবার বলছিলাম, আমাকে কিন্তু কবি জীবনান্দ দাস'র চোখে দেখা সেই বনলতা সেন-এর বাড়ি নিয়ে যাবে। আমার খুব দেখার ইচ্ছে, এখন সেই বাড়িতে যেই মহিলা বা পরবর্তী প্রজন্মরা আছে তারাও দেখতে কি সেই বনলতার মতো সুন্দরী কিনা।

আমার যতোটা মনে পড়ে কোনো এক পাঠ্য বইতে আমরা পড়েছিলাম, ইরানের মেয়েরা দেখতে নাকি অনেক সুন্দরী হয়। একারণে এদের ইরানের গোলাপ বলা হয়। তার মানে ধরে নেওয়া যায়, ইরানের সব মেয়েই দেখতে খুব সুন্দরী, গোলাপের মতো। এ কারণেই আমি মনে-মনে হিসাব কষেছিলাম নাটোরের সব মেয়েই বোধ হয় বনলতা সেন-এর মতো হবে দেখতে।

আমার বন্ধুর নাম ছিলো লিমন। লিমনকে যাত্রা পথে যে এতোবার এতোভাবে বলেছিলাম বনলতাদের বাড়িটি দেখানোর কথা সে একবার ভুল করেও বলেনি বনলতা বলতে কেউ ছিলো কিনা। এমনকি, বিষয়টি যে কবির কল্পনাও হতে পারে সেকথা তার মনে হয় মাথায় আসেনি। যে কারণে আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, লিমন আমাকে তার এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখাবে আর সেই সময় আমি ঐতিহাসিক এক ঘটনার উদঘাটন করতে পারবো। সেই রোমাঞ্চকর মূহুর্তের কথা মনে করে একটু পরপর বাস যেখানেই থামছে সেখানেই তাকে কিছু না কিছু কিনে খাওয়াচ্ছি, নিজেও খাচ্ছি।

যাত্রা পথে রাস্তার এই ধূলাবালি মাখা খাবার খেতে আলাদা একটা আনন্দও আছে। সেজন্য আমি খুব মজা করে খাচ্ছি এবং তাকে খেতে বলছি। আর ভাবছি-আমি শুধু শুধু যাচ্ছি না। একটা বড় কাজও হবে নাটোর গিয়ে। আমি সাহিত্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করি বলে এসব বিষয়ে আগ্রহ একটু বেশি হলেও লিমনের মধ্যে সেই ভাবনা একদমই কম। লিমন ঢাকা শহরে চাকরি করে আর গ্রামে তার পরিবারকে সাহায্য করে। বাস্তবে সে তার জীবন যুদ্ধ আমার আগেই শুরু করেছে আর এ কারণেই দুজনের আলাপের বিষয় আর মিলে না। আর এজন্যই সে সুযোগ পেলেই বাসে সিটের পিছনে হেলান দিয়ে শুধু ঘুমায়।

বাসে বসে আমি মনে মনে কল্পনা করছিলাম। লিমনদের বাড়ি যেতে যেতে বিকেল বা সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এখন বাড়ির আশে পাশে রাস্তা বা কোনো বাড়িতে ঘুরে সময় কাটবো। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর যে কোনো কাজ নেই। গ্রামের লোকজন এমনিতেই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।  আবার সূর্য তার আলো ছড়ানোর আগে সকালে উঠে পড়ে। তাই আমি নিজের মতো করে রাতের আধার নামার আগে একাই এলাকা ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে থাকি।

একসময় বাস এসে থামে নির্ধারিত গন্তব্যে। আমরাও বাস থেকে নামি। নেমে এক কাপ চিনির সিরাপের মতো গরম মিষ্টি চা খেয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেই। বাস থেকে নেমে অটোতে লিমনদের বাড়ি যেতে যতোটা সময় লেগেছিলো এর মধ্যে অজানা কারণে আমি ক্রমান্বয়ে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। লিমন অটোতে বসে রসিকতা করে বলেছিলো, আমাদের এলাকায় অনেক বনলতা আছে। যদিও সেন নেই। ভুল করে আবার ওসব বনের লতা পাতার সাথে জড়িয়ে যেয়ো না যেন। মন দেয়া নেয়া হয়ে গেলে দেখা যাবে শেষে আমার সমস্যা হতে পারে। আমি ভাই কোন বিচার শালিশ করার পক্ষে নই। তবে কোনো সেন টেন চোখে ধরলে, চাইলে তুমি তোমার সাথে করে ঢাকা নিয়ে যেতে পারো। এতে করে কোন বাবা মা হয়তো রেহায় পাবে। তবে মন রেখে যাওয়া চলবে না।

লিমনের এমন কথায় আমার মনে কিছুটা হলেও নতুন করে রোমাঞ্চের সৃষ্টি হয়। তাই তাকে বেরসিক মনে করলেও কয়েক মিনিটের পথ হাসাহাসির মধ্যে কাটালাম। বললাম, - তা-ও ভালো। তবু যে বনের লতাপাতা। তোমাদের বাড়ির আশে পাশের হলে বিপদের শংকা যে থেকেই যেতো।
 
লিমন বলল,আমার তো মনে হয় এবার তুমি নাটোর ঘুরে গিয়ে গল্প লিখতে শুরু করবে।
আমিও তাকে রসিকতা করে বললাম,গল্প লিখতে যে রসদ দরকার তা পেলেই হয়।
পাবে তো অনেকই। তবে তোমার গল্পের জন্য পার্ফেক্ট হবে কিনা তা বলতে পারি না।
কথা বলতে বলতে পৌছে গেলাম লিমনদের বাড়ি। মজার বিষয় ছিলো, লিমনদের বাড়িতে যেতেই দেখা হয় সেই কয়েকবছর আগে ঢাকা দেখা হওয়া লরেটোর সাথে। দেখে লরেটো প্রথম মনে করতে পারছিলো না আমাকে। আমি দেখেই তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলাম, -আমাকে আপনি চিনতে পেরেছেন?
 লরেটো অনেকটা সময় নিয়ে ভাবছিলো। আমাকে নিয়ে তার এমন আচমকা ভাবনায় ডুবে যাওয়া দেখে আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে বললাম, - নাটোরের বনলতা সেন নাম দিয়েছিলাম আপনাকে। আমি সেই জন। এবার মনে পড়লো কিছু? এখানে এভাবে আপনার সাথে যে দেখা হয়ে যাবে; আসার আগে আমি ভাবতেই পারিনি।
সে রাতে আমার সাথে লরেটোর আর দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি। তার বাড়ি লিমনদের একই গ্রামে। কোনো প্রয়োজনে এসেছিলেন হয়তো লিমনদের বাড়ি।
 পরের দিন লিমনকে নিয়ে চলে যাই লরেটোদের বাড়ি। আমাকে অনেক সমাদর করে লরেটো। পরিচয় করিয়ে দেয় তার বাবা মার সাথে। এরপর যে কয়দিন থাকা হয়েছে আমার নাটোর, প্রতিদিনই আমাদের দেখা এবং কথা হয়েছে। বেশ জমে উঠেছিল আমাদের দুজনের ভাব আদান প্রদানে।
অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসার আগে আমি লরেটোদের বাড়ি যাই। বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় বললাম, আমার খুব আশা ছিল এই নাটোর এসে জীবনান্দ দাস'র বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেনের বাড়ি দেখে যাবার। পুরো নাটোর জুড়ে আমি সেই কবির কল্পিত সুন্দরের প্রতীক, তার লেখার অনুপ্রেরণাদানকারী বনলতার কোন নাম গন্ধই পাইনি । তবে এতে যতোটা না কষ্ট নিয়ে ঢাকা ফিরছি, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ নিয়ে ঢাকা ফিরছি তোমার সাথে দেখা হওয়ায়।
  
কবির বনলতা সেনকে না পেলে কি হবে, আমার বনলতাকে যে আমি আবার খুঁজে পেয়েছি নাটোর এসে। এজন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। এতে তোমার বাড়িটাও আমার দেখা হয়ে গেলো। আমি কবিতা না লিখলে কি হবে, তোমাকে নিয়ে নতুন করে না হয় আমি গল্প লিখবো। তোমার কথা মনে রেখে আমি না হয় হয়ে যাবো গল্পকার।এরপর আমি লরেটোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। তারপর .........