ছবি:টোকিও বাংলা নিউজ
ঢাকা থেকে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলাম। বাংলাদেশ রেলওয়ের যে অবস্থা, তাতে আর যা-ই বলি এটাকে যাত্রীসেবা বলা যাবে না। ট্রেনটির শোভন চেয়ারের গায়ে লেখা‘আপনার আস্থাই আমাদের অনুপ্রেরণা : বাংলাদেশ রেলওয়ে’। লেখাটি যথার্থ মনে করতে হবে। কারণ যাত্রীদের তো রেল বিভাগের ওপর আস্থাই নেই, তাই অনুপ্রেরণাও সে রকমই। আর যে রকম অনুপ্রেরণা, সেবাও সে রকম।
‘চ’ বগির মাঝামাঝিতে আমার আসন। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে বিরক্তি লাগছিল। ট্রেনে হরেক কিসিমের মানুষের বাহারী রকম আলাপ। পাড়ার চায়ের দোকান আর ট্রেন-বাসের যাত্রাপথে রাজ্যের সব বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকদের দেখা পাওয়া যায়। সম্ভবত এদের আড্ডার ধরন থেকেই টিভি চ্যানেলগুলো টক-শো’র ধারণা পেয়েছে।
সামনের সিটে একজন মধ্যবয়সী লোক পেপার পড়ছিলেন। হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। জায়গাটার পরিচয় জানতে অনেকেই জানালা দিয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি দেবার চেষ্টা করছিল। পেপার পড়া লোকটার পাশের সিটে বসে একজন ঘুমাচ্ছিলেন। ট্রেন থামতেই প্রচন্ড ঝাঁকিতে তিনি উনার উপর ঝুঁকে পড়লেন। পেপারের ওপর থেকে মুখটা তুলে কিছুটা রাগ নিয়ে উনি বললেন
‘কী ব্যাপার ভাই! বসতে দেবেন না নাকি’?
‘স্যরি ভাই। খেয়াল করিনি। তাছাড়া ট্রেন তো হঠাৎ থেমে গেছে, তাই টাল সামলাতে পারি নাই’। ঝুঁকে পড়া লোকটা জবাব দিলেন।
‘আচ্ছা হয়েছে। আইজকাল দেশে যা কালচার শুরু হইছে রে ভাই, স্যরি বলেই সব পার’!
দুজনের কথার প্রসঙ্গ শেষ হবার আগেই পেছন দিকে কয়েকজন যুবকের কথা তাদের কানে ঢুকলো।
‘ওই দ্যাখ, ট্রেন থেকে একজন মহিলা নামল। মনে হয় মহিলাটা ট্রেনের ড্রাইভারের প্রেমিকা’। এক যুবক অন্য যুবককে বাইরের দিকে ইশারা করে বললো।
অন্যজন বললো, ‘ধুর শালা, প্রেমিকা না। মনে হয় বউ’!
‘হ তোরে কইছে! বউ ক্যামনে বুঝলি’? প্রথমজন বললো।
দ্বিতীয়জনের জবাব, ‘আরে গাধা প্রেমিকা হইলে তো বেচারা ড্রাইভার ট্রেনটা আরো কিছুক্ষণ দাঁড় করায় রাখতো। যতক্ষণ বেচারি চোখের আড়াল না হয়, ততক্ষণ ছাড়ার কথা না’। একসাথে থাকা ওরা কয়েকজন হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ড্রাইভারের মতিগতি বুঝবার উপায় নেই। ট্রেন মাঝেমধ্যেই স্টেশন ছাড়াও দাঁড়ায়। তখন রেললাইনের আশপাশের এলাকার যাত্রী থাকলে তারা সহজেই নেমে পড়ে।
আসলে ওদের মনোযোগ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দিকে। ছেলেদের কথা শুনে মেয়েরাও হাসতে লাগল। একজন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়ছিল। ছেলেদের হাসি সচরাচর একই রকম হয়, কিন্তু মেয়েরা হাসলে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ পাওয়া যায়। ছেলেদের সামান্য কিছুতে মেয়েরা হেসে মজা নেয়। অথচ এই একই কাজ ছেলেরা করলে ইভটিজিং হয়ে যায়।
ছেলেদের হাসি-তামাশায় পেপার পড়া লোকটার মধ্যে বিরক্তি দেখা গেল। পাশেরজনকে স্বাক্ষী করে বলতে লাগলেন
‘দেখেন তো, কী ধরনের অসভ্য পোলাপান। ট্রেনের মইধ্যেও হাউকাউ শুরু করছে’!
‘আসলে কী বলব বলেন। ওদের বয়সটাই যে এখন এমন’! পাশেরজন বললেন।
‘তাই বলেই! এমন বয়সী কি আমরা ছিলাম না! যা হোক, এই যে দেখেন শাহবাগ মোড়ে কিছু পোলাপান আন্দোলন করতেছে কোটা সংস্কার দাবিতে। বলেন তো, এই সব করে কোনো লাভ আছে? আজীবন এই স্বপ্ন ওদের পূর্ণ হইবো’? পেপারে একটা সংবাদ দেখিয়ে লোকটা বললেন।
পাশেরজন বললেন, ‘লাভ-লস তো পরের কথা, ওদের দাবিতে কিন্তু যুক্তি আছে’।
‘আরে ভাই, যুক্তি থাক। মোটা পয়সা ছাড়া এই যুগে কোনো চাকরি আছে কন? মেধা দিয়ে কিচ্ছু হয়’?
‘যা-ই বলেন ভাইজান, কোটা আর ঘুষ দুইটাই তো মেধাকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে’।
‘এই যে দেখেন ‘অগ্নিকন্যা’ মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে জড়িতরা ‘রাজাকারের বাচ্চা’! আচ্ছা বলেন তো ছেলেপেলেরা এখন বিপদে পড়ে যাবে না’! কথাটা শুনে পাশের লোকটা শুকনো একটু হেসে ফেললেন। বললেন
‘রাজাকারের বাচ্চারাও তাইলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়া শাহবাগ চত্বর কাঁপায়’!
‘ধুর মিয়া, কী কন না কন! কোটা থাকলেই সমস্যা কী? যার কোটা আছে, চাকরি পাবে। যার মোটা পয়সা আছে, সেও চাকরি পাবে। যার কিছুই নাই তার তো মাথা আছে, ওই মাথা ঘরেই খাটাবে’! লোকটা একটানা বলেই যাচ্ছেন, ‘শোনেন, আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা মেট্টিকের পর প্রাইমারি ইশকুলের শিক্ষক হইছে। বড় ছেলেটা মেট্টিক পাস করে নাই, তবে আগে থেকেই রাজনীতি করে তো, তাই এমপি সাব এইবার তারে গ্রামের হাইস্কুলের সভাপতি বানাইছে। আর ছোট ছেলেটা, বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম; সমস্যা নাই, দুইবারে ইন্টার পরীক্ষা দিয়া পাস করছে, এইবার মাশাল্লাহ্ এলজিইডিতে ঢুকলো। এই সবের জন্য বহুত টাকা গ্যাছে, তাতে কী! এখন আমি তো মনে করি আমার গ্রামে একমাত্র আমার পোলাপানই যোগ্য’!
লোকটার কথাগুলো আমি শুনে যাচ্ছিলাম। মাঝেমধ্যে আমাকেও তিনি স্বাক্ষী করতে চাইলেন। ঘুমের ভান করে সিটে হেলান দিয়ে থাকলাম। ভাবতেই অবাক লাগে, ছেলেদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম ডিগ্রি পাস, সেখানে মেয়েদের ক্ষেত্রে মাত্র এসএসসি! যেন মেয়েদের এসএসসি পড়ে যে বিদ্যা অর্জন হয়, ছেলেদের সেটুকু অর্জন করতে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়তে হয়! আবার রাজনীতি জানা থাকলে পড়াশোনা কম করলেও অনার্স-মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকদের চালাবার জন্য বিদ্যালয়ের সভাপতিও হওয়া যায়।
লোকটার কথা শুনে পাশের ব্যক্তি আর কোনো মন্তব্য করলেন না। সিট ছেড়ে উঠে গেলেন। হয়তো টয়লেটেও যেতে পারেন। আমার মনের মধ্যে নানাকিছু উঁকি দিচ্ছিল। আমার পাশের গ্রামের এক রাজাকারের ছেলের সাথে এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওই দম্পতির কন্যাকে পড়াশোনার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ক্যাডেট কলেজে আবেদন করেন অভিভাবক। দাদা রাজাকার হলেও নানার মুক্তিযোদ্ধা কোটার জোরে নাতির ‘পোয়াবারো’। কী অবাক বাংলাদেশ!
নানাকিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ট্রেনের মধ্যে হৈ চৈ শুনতে পেলাম। আমার সিটের পেছনে বগির শেষদিকে জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম। জানতে পারলাম, এক মহিলার প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে। প্রসূতির সাথে থাকা দুজন মহিলা কোনোরকম শাড়ির আঁচল দিয়ে প্রসবস্থল ঘেরাও করে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছেন। আমি সিটে এসে ব্যাগে থাকা একটা লুঙ্গি নিয়ে গেলাম, যাতে তাঁদের আরো একটু সুবিধা হয়। সাথে পানিভর্তি বোতলটাও নিয়ে গেলাম, কাজে লাগতে পারে ভেবে। আমি যেতে যেতেই বাচ্চা প্রসব হয়ে গেছে। ফুটফুটে মেয়ে।
পেশায় সংবাদকর্মী হিসেবে প্রসূতির পরিবারের সাথে কথা বলতে চাইলাম। তাছাড়া বাচ্চাটি দেখবার লোভও সামলাতে পারলাম না। প্রসূতির শাশুড়ি মজিদা বেগম জানালেন, ‘তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার উত্তরী গ্রামে। ছেলে আল-আমিন ইটভাটার শ্রমিক। ছেলের বউ সুজি বেগমকে নিয়ে কম খরচে ডাক্তার দেখাবার জন্য তাঁরা ময়মনসিংহ শহরের সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এরমধ্যেই প্রসব ব্যথা ওঠে তাঁর।
তখন দুপুর পৌনে একটা। ট্রেন ময়মনসিংহ জংশনে এসে থামলো। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাচ্চাটি কোলে নেবার সুযোগ পেলাম না। আমাকে পরের স্টেশনে নামতে হবে। বাড়িতে বাবা অসুস্থ, দেরি করা যাবে না। প্রসূতিকে ট্রেন থেকে নামতে সাধ্যমতো সহযোগিতা করলাম। কোনোরকমে দ্রুত তাঁদের মোবাইল নম্বরটি নিয়ে নিলাম, পরে খোঁজ নেব বলে। সৈয়দ নোমান ময়মনসিংহ শহরের নামকরা সাংবাদিক। সার্বিক বিষয়টা তাঁকে মোবাইলে জানালাম, হাসপাতালে প্রসূতি ও নবজাতকের খোঁজখবর নেবার জন্য।
যুবকদের দুষ্টুমিতে যেসব মেয়েরা হাসাহাসি করছিল; তারা সুজি বেগম যেখানে প্রসব করলেন তার একটু দূরেই দাঁড়ানো। ডজনখানেক হবে। ওরা সবাই মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। কিন্তু সে সময় প্রসব যন্ত্রণায় কাতরানো সুজি বেগম বা তার নবজাতকের কাছে একজনও এগিয়ে আসেনি। এরমধ্যে কেউ কেউ নাকে টিস্যু, রুমাল, ওড়না চেপে গন্ধ ঠেকাবার চেষ্টাও করছিল। একজন আমার পূর্ব পরিচিত। সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় বাবা-মা তাকে একটি প্রাইভেট মেডিকেল ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছেন ২৫ লাখ টাকার চুক্তিতে। টাকাগুলো উসুলের জন্য কসাই হতে আর বেশিদিন হয়তো দেরি নেই তার! প্রজন্মকে কী শিখিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র; এখানে দায়িত্বের চেয়ে ব্যক্তিত্ব প্রাধান্য পায়, মেধার চেয়ে টাকা গুরুত্ব পায়, যোগ্যতার চেয়ে কোটা এগিয়ে যায়,মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে কোথা থেকে! ভাবতে ভাবতে ট্রেন জামালপুর স্টেশনে থেমে গেল। ট্রেন থেকে নেমে আমার গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
রচনা : ১৮ এপ্রিল ২০১৮।
লেখক পরিচিতি
জন্ম : ৭ আগস্ট ১৯৮৫, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায়।
পড়াশোনা : দুই বিষয়ে স্নাতকোত্তর।
পেশা : সাংবাদিকতা। সমসাময়িক বিষয়ে জাতীয় দৈনিকের কলাম লেখক।
সিনিয়র সহ-সভাপতি, বঙ্গভ‚মি সাহিত্য পর্ষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
প্রকাশিত বই, কাব্যগ্রন্থ : মেহেদি পাতার রঙ (২০১৮), ভুল-পাওয়ারের চশমা (২০১৯), অস্পর্শ চাঁদ (২০২০) এবং যৌথ আরো তিনটি। প্রবন্ধগ্রন্থ : বাইরে ভাইরাস ভেতরে ক্ষুধা (২০২১)।
আর সি