- শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

অন্তঃসত্ত্বা

অনুপমা চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১

অন্তঃসত্ত্বা

গত কয়েকদিন ধরে শীতের খুব জোরালো প্রভাব পড়েছে। ভোরে কুয়াশা আর গোধুলীবেলায় দূরন্ত হিমেল হাওয়া শরীরের সবটায় যেন স্পর্শময় কাঁপুনি দিয়ে অনুভূতির জানান দিয়ে যায়, শীত এসেছে। যদিও প্রকৃতির রূপের পরিবর্তন দেখতে চাইলে গ্রামীন পরিবেশে শীতের শুরুটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থায় বিরাজমান; এখানকার মেঠোপথ, নদীর স্থির জলে ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে বেড়ানো, ফসলের খেত, শিউলি ফুলের মনমাতানো গন্ধ, হাসনাহেনার মাদকতাময় সুবাস সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতির এক অনন্য নৈসর্গিক সৌন্দর্য দর্শন। 
 
গতকাল মধ্যবেলায় অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম; সন্ধ্যার কিছু আগে পৌঁছে দেখলাম নতুন চালের পিঠার মেলা বসেছে উঠোনজুড়ে। হাতমুখ ধোয়া হতে না হতেই মা চিতই আর ভাপা সাজিয়ে একটা সাদা পিরিচ নিয়ে হাজির। পিঠার উপর হতে বের হয়ে আসা সুগন্ধিযুক্ত গরম ধোয়ায় সকল ক্লান্তি নিমিষে মিলিয়ে শেষ। এরপর চলে মা-ছেলের কৌশলাদি বিনিময়। রাত আটটা বেজে নয়, রাতের খাবার শেষ করে লেপে মুড়ি দিলে যে ঘুম নামলো চোখে তাতে আমি একবারে গহীন গহŸরে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি বুঝি কিন্তু না ঘোরে থাকতেই দরজায় কড়া পড়েছে বারবার। এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভাঙলো, খুব কষ্টে কনকনে ঠান্ডায় বের হয়ে এলাম, গরম লেপের গন্ডি ছেড়ে। দরজা খুললে মেজো ভাবী বলে উঠলেন যে, সমীরণ কাকী আর নেই। তখনো ঘুমটা যেন আগপাশ জড়িয়ে আছে তাই শুনেও পুরোটা পরিস্কার হলো না। উচ্চস্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে! প্রতিউত্তরে আরেকবার জানালেন যে, সমীরণ কাকী মারা গেছেন। আর দেরী নয়, আলনা থেকে জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে ছুটলাম। ঐ সময়ে শীত-গ্রীষ্মটা যেন কেমন একটা বোধহীন মায়ায় আঁকড়ে ধরলো শুধু বুঝতে পারলাম বুকের ভেতর চরম ব্যথা বোধ হচ্ছে। এক দৌঁড়ে উঠোন পার করে লাফিয়ে পাশের ভিটায় জড়ো হওয়া মানুষের ভিড় ঠেলে কোনমতে মাঝখানটায় পোঁছাতে চেষ্টা করলাম। দেখি! মা কাঁদছেন সমীরণ কাকীর হাতটা বুকে জড়িয়ে। সমীরণ কাকী আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী আর এই ঘনিষ্ঠতা সকল আপনজনদের ঘনিষ্ঠতার উপরে স্থান করে নিয়েছিল আজীবন। কেননা, আমাদের পরিবারের জন্য তার আত্মত্যাগ এতোটাই যে সেখানে অন্য সবকিছু অর্থহীন, কখনো হয়তো শব্দহীনও।
 
১৯৭১ সাল-
বাবা এবং সমীরণ কাকীর স্বামী নিবারণ চক্রবর্তী আমাদের ‘নিকা’ খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন একে অপরের সাথে। বলতে গেলে ভালো একটা বন্ধুত্বের চেয়েও অনেক বেশি এই গভীরতা টান; এতোটাই সুহৃদ যে একসময় মিলিতভাবে ব্যবসায়িক কাজেও তারা অগ্রসর হন। খুববেশি সময় নেয়নি যেটা সকলের দৃষ্টি কাড়তে। এদিকে স্বাধীনতার ডাকে পুরো দেশ উত্তাল তখন। মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি গড়লেন আমাদের গোডাউনে, বাবা-কাকাও স্বেচ্ছায় সেটি ব্যবহার করার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং বাংলার গর্বিত এই সন্তানদের সবধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদানেও কখনো পিছপা হলেন না। মা আর সমীরণ কাকী প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাঁথা সেলাইয়ের ছলে গল্প জুড়ে দিতেন- কি হবে দেশটির, সত্যিই কি আমাদের বাংলা কখনো স্বাধীন হবে, আরো নানা অজানা সংশয়!
আমাদের দুই পরিবারের থেকে মূলত এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু ঐ যে অনেকের চোখে বাবা আর নিবারণ কাকার বন্ধুত্ব ভালো লাগতো না, তারাই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধকালীন অস্থিরতার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে দেয়। রাজাকারের দল পাকক্যাম্পে খোঁজ দিল গোডাউনের। গভীর রাতে যখন নকশা হচ্ছিল পাকিদের আক্রমণের তখন বাবা-কাকা সেখানে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজে বোমা বিস্ফোরণ, গেটটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল নিমিষেই। এর মাঝে আমাদের বীরসেনাদের সাথে পাকবাহিনীর পাল্টা গুলি বর্ষণ চলছে। অন্যদিকে নিরস্ত্র দুই বন্ধু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সামনের পথে দৌঁড়ে যায়; হয় বাঁচবে নয় শেষটা বাড়িতে যেয়ে আর নয়তো অন্তিম পথে যাত্রা। অতি দ্রæত বেগে এক পর্যায়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা আর ঠিক ঐ সময়টাতেই নিকার পায়ে গুলি লাগে। যা নিয়ে এগোতে গেলে ফের আরেকটা গুলি এসে বামপাশের বুকটা ছিদ্র করে যায়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিকা। বাবা পিছন ফিরে দৌঁড়ে এসে প্রাণের বন্ধুটিকে শেষবারের মতো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন - “নিবারণ রে, আমি বুঝি তোকে আর বাঁচাতে পারলাম না”। থরথর কাঁপছে পুরো শরীরটা কাকার, বাবার হাতটা কোনমতে বুকে নিয়ে খুব কষ্ট করে শেষ অনুরোধ জানালেন প্রিয় বন্ধুর কাছে - ‘কথা দে, এখন তুই আমার বাড়ি যাবি, ভুলেও তোর বাড়ির দিকে পা বাড়াবি না’! ঐ সময়ে কেন এমন অদ্ভূত চাওয়া ছিল বাবা নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি শুধু তার কষ্ট থামাতে খুব সহজে মেনেছিলেন - ‘তুই যা বলবি আমি তাই করবো’।
 
মিনিট পার হলো না, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন নিকা। চারপাশের ঝাঁঝালো শব্দে বাবাকে যেন বোধহীন করে তুললো এবার, অত্যন্ত কাছের মানুষের প্রতি সকল মায়া নিমিষে ছেড়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার দৌঁড় দিলেন তিনি। কিন্তু উঠোনে পা রাখতে গেলে মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগে গত হওয়া বন্ধুকে দেয়া শেষ প্রতিশ্রæতি। মোড় ঘুরে পাশের বাড়িতে ঢুকে নিবারণ কাকার ঘরে জোরে জোরে কড়া নাড়তে শুরু করেন বাবা। কাকীমা হারিকেন হাতে দরজা খুলে মুখে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন- ‘এতো রাত্রি করো, পাকিদের হাতে কখন যে গর্দানটা যায় তোমার’। হয়তো হারিকেনের মৃদু আলোতে বাবার মাফলারে প্যাঁচানো মুখটা তখনো বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। এবার মাফলার খুলে যখন দু’হাত জোড় করে বললেন যে, বৌদি বাঁচান, ওরা আমার পিঁছু নিয়েছে সাথে আবার চারপাশ থেকে ভেসে আসা বুটের উচ্চ শব্দে রাত্রিটা আরো বেশি অন্ধকারময় তখন সবমিলিয়ে সমীরণ কাকীর কাছে বেশ স্পষ্ট - এ যে ঘোর বিপত্তি, শত্রæরা তার দুয়ারে চলে এসেছে!
 
খুব দ্রæত বাবাকে ধানের গোলাতে ঢুকিয়ে দিয়ে এককচ বাঁসন হাতে সজোরে টিউবওয়েল পাড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাঁড়ান কাকী ঘরের দরজা খুলে। কিন্তু কিছু দূর এগোতে গেলেই বেশকিছু সিপাহী তাকে ঘেরাও দিয়ে ধরে এবং এইমাত্র বাড়িতে যে ঢুকেছে তাকে বের করে দিতে কঠিন চাপ প্রয়োগ করে। উচ্চস্বরে প্রতিউত্তর দিলেন এবার সমীরণ কাকী- ‘বাড়ীতে কেউ নেই’। এরপর ছুটাছুটি শুরু করে সিপাহীরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাবাকে না পেয়ে কাকীর উপর ক্ষেঁপে যায় তারা এবং শূন্যে করে উঠিয়ে নিয়ে ঘরে এসে চালায় অমানবিক নির্যাতন। পুরো ঘটনা বাবা ধানের গোলার ছিদ্র দিয়ে দেখে গেছেন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, এমনকি শুনেও ছিলেন কাকীর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফটানো সেই গোঙরানি আওয়াজ। সেদিন প্রাণের মায়ায় হয়তো কিছু করতে পারেননি ঠিক তবে আত্মচিৎকারে চিরদিনের মতো বাঁকহীন হয়ে পড়েন তিনি।
 
ভোর হল। 
ধানের গোলা থেকে ভীষণ অপ্রকৃতস্থভাবে বেরিয়ে বাড়িতে এসে দরজার সামনে পড়লেন বাবা। সারারাত বাড়িতে ফিরেননি, বাহির থেকে শব্দ হতে মা দ্রুত দরজা খুললেন। বাবাকে এরূপ বিধ্বস্ত অবস্থায় জ্ঞান হারাতে দেখে মাও খুব অস্থিরভাবে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে যান। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে জ্ঞান ফিরে আসলো। আকার ইঙ্গিতে কি যেন বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি কিন্তু পারলেন না তবে মূহুর্তেই মা বুঝে নিলেন যে তার স্বামী বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। অবারিত অশ্রæধারায় দুজনেই ভেসে চলেছেন দুজনের দিকে তাকিয়ে। বোঝাতে ব্যর্থ হলে এক পর্যায়ে মাকে টেনে নিয়ে যান বাবা নিকার বাড়িতে। সেখানে সমীরণ কাকীর ছিন্নবস্ত্রে দেহ অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে দেখতে পেয়ে মা দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। এদিকে বাবা দরজার সামনে বারবার কেঁদে হয় দিশেহারা। বহু চেষ্টায়ও যখন জ্ঞান ফিরাতে পারলেন না কাকীর তখন খুব কষ্টে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করা হল। 
 
মাসখানেক নিবিড় পর্যবেক্ষণে সমীরণ কাকী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। এ সময়টা মা আর তার বাবার বাড়ির কিছু লোকজন নিয়মিত দেখাশোনা করতে আসলে বারবার জানতে চেয়েছেন নিবারণ কাকার সম্পর্কে। কিন্তু সবাই কোন না কোনভাবে এড়িয়ে যায় তাই মাস পার হলেও জানা হয়ে উঠেনি, তিনি বিধবা। এবার বাড়িতে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেন কাকী কিন্তু চারপাশটা জানান দিয়ে যায় আগের মতো আর কিছু নেই সব শেষ হয়ে গেছে; ঐ রাতেই নিবারণ কাকা মারা গেছেন যে রাতে তার বন্ধুর জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের সম্ভ্রমটুকুও ত্যাগ করেছিলেন; শুধু তাই নয় বাবার চিরদিনের মতো বাকশক্তি হারিয়ে যাওয়াও কাকীকে নাড়া দিয়ে যায় সেই কঠিন সময়টাতে। অধিক কষ্টে মানুষ বোধহয় সত্যি অনেকবেশি শক্ত হয়ে যায়। সমীরণ কাকীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। ঐদিনের পর থেকে একফোঁটা চোখের জলও তিনি ফেলেননি, মুখেও কখনো দেখা যায়নি কারণে অকারণে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, শুধু বেঁচে গেছেন বাঁচতে হবে বলে। কয়েক মাস পার হল। জানা গেল, কাকী অন্তসত্বা- কিন্তু, আমাদের সমাজ কি নাম দেবে এর! 
 
বাবা মারা গেলেন এর মাঝে। যাবার আগে একটা ডায়েরীতে রাতদিন বসে কি যেন লেখালিখি করতেন আর অঝোরে কেঁদে যেতেন। যদিও সেখান থেকেই মা এবং আমরা জানতে পারি সেদিন-সে’রাতে ঠিক কি হয়েছিল, পরিশেষে কাকীর চূড়ান্ত আত্মত্যাগ বাবা এবং আমাদের পরিবারের জন্যে। অন্যথায়, ঐদিন সে ঘটনাটি মার জন্য বরাদ্দ ছিল যদি নিকার কথা বাবা না শুনতেন। এইকি তবে প্রকৃত বন্ধুত্ব, যার স্বার্থে সবকিছু ত্যাগ করা যায়! জানা হল, বন্ধু কি!
 
আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে মা শক্তভাবে দাঁড়ালেন সমীরণ কাকীর পাশে- ‘আমরা লড়বো কিন্তু ভাঙবো না’। 
 
দেশ স্বাধীন হলো; কত মানুষ উৎসুক, আনন্দিত অথচ এর পেছনে কত মানুষের কত কত মহান আত্মত্যাগ, কত নারীর সম্ভ্রম হারানোর তীব্র বেদনা ইতিহাস তার কতোটাইবা হিসাব রাখে, খোঁজটাইবা কই!
 
কিছুদিন পার হল। হঠাৎ একদিন গ্রামের মোড়ল সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ করতে থাকে যে, নিবারণের বউকে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি নিতে হবে। কিন্তু মা আর কাকী শক্তভাবে স্থির থেকে সেই চাপকে প্রতিহত করে যান। দিন না যেতে একটি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। বুকের ভেতর পাষাণ বেঁধে আরেকটাবার যেন ঘুরে দাঁড়ানো। দিন যায়, হয়ে উঠেন তিনি আরো শান্ত; সবটাই হয়তো শুধু বেঁচে থাকা তবে সত্যি কি এ বেঁচে থাকা!
 
স্বামীর ভিটা ছেড়ে যাননি কখনো বরং শেষ সম্বল আবাদী জমিটুকুকে আশ্রয় করে সমীরণ কাকী তার অসুস্থ ছেলেটির সাথে দিন যাপন শুরু করেছিলেন। এদিকে মাও প্রয়াত দুই বন্ধুর ফেলে যাওয়া ব্যবসাটিকে আগলে খুব কষ্ট করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান যেহেতু সময়টি অনুকূলে না তারপর আবার তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রটা খুববেশি চ্যালেঞ্জিং। 
 
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক যে শেষ অবধি এটাও সইলো না কপালে, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে দশ দশটি বছর যে ছেলেটির জন্য সমীরণ কাকীকে উঠতে বসতে মানুষের অজ¯্র ভৎসনার শিকার হতে হল, শুনতে হল- নিজ স্বামী নয় পাকিদের দূষিত বীর্যের দ্বারা তার সন্তানের জন্ম সেই নির্বোধ আত্মাটিকে আর তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। একদিন রাতে ঘুমের মাঝে দরজা খুলে কোথায় যে হারিয়ে যায় ছেলেটি, আজো তার সন্ধান মেলেনি। এতো এতো কষ্ট, বাঁধ ভাঙা যন্ত্রণার পরও কিন্তু নিকার সহধর্মিনী বিন্দুমাত্র ভাঙলেন না এমনকি কোন ক্ষোভও নেই পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে; আফসালিটা যেন একান্ত ব্যক্তিগত কখনোই যা দৃশ্যমান হয়নি- না সমাজের কাছে না আমাদের।
 
শুরু হল বেঁচে থাকার পরবর্তী ধাপ। একদিকে যেমন নিশ্চুপ আবাদ করে যাওয়া স্বামীর ফেলে যাওয়া একটুকরো মাটির খন্ডে সোনার ফসল অপরদিকে আমাদের তিন ভাইয়ের মাঝে বেঁচে থাকার একটুখানি সামান্য নির্যাস খুঁজে নেয়া। আমরাও বেড়ে উঠলাম মা এবং সমীরণ কাকীর যৌথ ছায়ায় যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আরো বেশি কঠিন যুদ্ধময় জীবনের পথ ধরে। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের এই দুটো পরিবারের করুণ আত্মত্যাগ থাকলেও কোন স্বীকৃতি ছিল না কখনো; কারণ, আমরা তা চাইনি বলে। হয়তো পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ এভাবেই বেঁচে থাকে; তারা ভালোবেসে ত্যাগ করে সর্বোচ্চ- মাটি ও মানুষের জন্য, স্বীকৃতির জন্য নয় এবং তাদের এই ভালোবাসার দলিল প্রতিষ্ঠা পায় কেবলমাত্র নিজের কাছে, আত্মার কাছে অন্যের দর্শনের সম্ভাবনাও যেখানে খুব সীমিত। স্বাধীন বাংলায় এরূপ অজ¯্র গল্প হয়তো মাটির নিচে পড়ে আছে এখনো; যে মাটির জন্য সমীরণ কাকীর মতো অসংখ্য মা অন্তসত্বা, যে মাটির জন্য তথাকথিত শব্দে এই অন্তসত্বা হয়ে উঠেন বীরাঙ্গনা।

আর এ এস/আর এ