- মঙ্গলবার ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ১৬ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

ডঃ আশির আহমেদ`র জাপান কাহিনী পড়ুন, জাপান কে জানুন

রাহমান মনি

প্রকাশিত: ০১:১৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ডঃ আশির আহমেদ`র জাপান কাহিনী পড়ুন, জাপান কে জানুন

ছবিঃ টোকিও বাংলা নিউজ

জাপানে পরিচিত বন্ধু মহলে ডঃ আশির বাবু নামেই সমধিক পরিচিত । আর বাবু প্রচন্ড আড্ডাবাজ  অত্যন্ত বন্ধুবৎসল বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষ ।

জাপান কাহিনির সপ্তম খন্ডে তার বহিঃপ্রকাশও করেছেন তিনি । তিনি পাঁচ বন্ধু তৌফিক , শাকন , আসিফ জাবেদ এবং সানাউল’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ  করে উৎসর্গ করেছেন । যারা  তাঁর অবর্তমানে সন্তানের মতো অভিভাবকদের  বিশেষ করে তাঁর পিতাকে সময় দিয়ে দেখভাল করেছেন । কৃতজ্ঞতা স্বীকার সবাই যেমন করতে পারে না । তেমনি সবাইকে দিয়ে তা হয়ও না । আর যিনি পারেন, তাকেই মানায় । যেমনটি পেরেছেন এবং মানিয়েছে  জাপান কাহিনি লেখক ডঃ আশির আহমেদকে করোনাকালীন  মহামারীর সময়ে লিখা জাপান কাহিনি ৭ম খণ্ডে বিভিন্ন গল্পে ঘুরে ফিরে যে করোনা বিষয়ক আলোচনা চলে আসবে তা তিনি ভুমিকাতে জানান দিয়েছেন ।

শুরুতেই ‘জাপানিজ প্যারেন্টি’ নামক গল্পে মহৎ একজন অভিভাবক যিনি বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তার সন্তানদের দুপুরের টিফিন এর সাথে মাতৃহীন এক শিক্ষার্থীর টিফিন সবার অগোচরে দিয়ে গেছেন সেই মহীয়সী মায়ের প্রতি নিজের অজান্তেই শ্রদ্ধা চলে আসে । কতোটা মহান হলে নিজের সন্তান এবং এবং সন্তানতুল্য সবার কাছেই গোপন রাখেন পাছে নিজেদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না হয় । পারিবারিক শিক্ষার আদর্শতা জাপানিজ প্যারেন্টি কে অনুকরণ করা যেতে পারে ।

‘জাপানে ছাত্র রাজনীতি’ গল্পে  তিনি বাংলাদেশ এবং জাপানের শিক্ষার্থীদের চিন্তা চেতনার তফাৎটা সু-কৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছেন । বাংলাদেশে ছাত্র -শিক্ষকরা যেখানে রাজনীতির নামে লেজুর ভিত্তিক দল করে সুবিধা আদায়ে ( চাঁদাবাজি , পদোন্নতি ) ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেখানে জাপানে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লাব গঠন করে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা সহ খেলাধুলার ক্লাবের মাধ্যমে নিজেরা শারীরীকভাবে সুস্থ  থাকার পাশাপাশি ক্রীড়া চর্চায় ব্যাস্ত থেকে বিশ্ব আসরে অংশ নিয়ে দেশের জন্য সন্মান বয়ে আনে । আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা তাদের উৎসাহিত করে থাকেন ।  ধর্মের দোহাই দিয়ে জাপানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করার অধিকার নেই।

শিশুদের জাপান কাহিনী গল্প পড়ে আমার নিজের বাল্য বেলার কথা মনে পড়ে যায়। মা’র কাছে কিছু আবদার করলেই মা শর্ত জুড়ে দিয়ে কাজ আদায় করে নিতেন। তারপরই কাঙ্ক্ষিত আবদার পূরণ হতো ।

জাপানে ২০০ ইয়েন দিয়ে সন্তানকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দেয়াটা যে কোন মায়ের পক্ষেই সম্ভব । কিন্তু , তারপরও মা তার সন্তানকে বাস্তবমুখী করে তোলার জন্য শর্ত জুড়ে দিয়ে কাজ আদায় করে নেন । অনেকটা  আমাদের কাবিখা’র ( কাজের বিনিময় খাদ্য ) মতো । হয়তো এর চেয়েও আরও বেশী কাজ মা করতে পারেন , করেনও , তারপরও চাহিবা মাত্রই যে সব পাওয়া যাবে না এই বাস্তব  এই শিক্ষাটা দেয়ার জন্যই শর্ত দেয়া। এই জন্যই জাপানীরা কর্মঠ এবং বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত হন । মায়ের কাছ থেকেই তা পেয়ে থাকে। মা হচ্ছেন সন্তানের প্রথম এবং আজীবন শিক্ষক।

জাপানি শিশুদের স্বাস্থ্য গল্পটিতে লেখক সন্তান লালন পালনে প্রাথমিক চিকিৎসক হিসেবে একজন মায়ের ভুমিকা ও দায়িত্ব সযত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন । একটি সন্তান একজন মায়ের নাড়ী ছেড়া ধন। তাই, সন্তানের নাড়ীর খবর অর্থাৎ সন্তান কখন খাচ্ছে , কি খাচ্ছে , কখন ঘুমুচ্ছে , কতক্ষন ঘুমুচ্ছে , তার গতিবিধি , হাসি কান্না , এমন কি তার মলমুত্র ত্যাগ এর বিবরণ পর্যন্ত একজন মা নোট করে রাখেন । প্রয়োজনে চিকিৎসককে তথ্য সরবরাহ করে সঠিক চিকিৎসার সহায়ক ভুমিকা পালন করে থাকেন একজন জাপানি মা ।

জাপানি গায়ক বাবা গল্পে লেখক ভেঙ্গে যাওয়া একটি পরিবারের কর্তা ব্যক্তির ছন্নছাড়া জীবন , জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে আত্মহত্যা করার চিন্তা করা, কন্যার উপস্থিতিতে আবার প্রানের ছোঁয়া , বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা , রক্ত বলে কথা । মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যে একটা অবলম্বন দরকার গল্পে তা স্পষ্টই ফুটে উঠেছে আলোচ্য গল্পে ।

সরকারী সম্পদ নিয়ে লিখাটি জাপান পুলিশের দেশপ্রেম এবং সরকারী সম্পত্তি রক্ষা করার যে শপথ তা পালনের সদা সচেষ্ট থাকে জাপানের পুলিশ । মোবাইল চার্জ এর মতো সামান্য একটু বিদ্যুৎ ব্যবহারেও পুলিশের সজাগ দৃষ্টি আর আমাদের দেশে সংশ্লিষ্টদের যোগসাজসেই সব কিছু হয়ে থাকে।

করোনাকালীন এই সময় ‘জাপানে করোনা’ নিয়ে লিখা গল্প টি যে শুধু পাঠকের জন্যই শিক্ষনীয় তা কিন্তু নয় ,অনুন্নত দেশ গুলো এবং তথাকথিত উন্নয়নশীল বনে যাওয়া দেশের নীতিনির্ধারকরা  যদি তাঁর গল্প থেকে প্রশ্ন এবং উত্তরগুলো খোঁজে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন তা হলে একদিকে তিনি নিজে যেমন উপকৃত হবেন তেমনি তার দেশ ও দেশের জনগণেরও যে কাজে আসবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় ।  

জাপানী ম্যানার যে বিশ্বখ্যাত তা সর্বজন বিদিত। কিন্তু কি কারনে সেরা তা জাপান কাহিনির ‘জাপানি বিনয়’ গল্পটি পড়লে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় । একই গল্পে টাকা হলেই যে  বাড়ির সৌন্দর্যে তা দেখানো উচিত নয় তা বুঝিয়ে দেন । আমাদের দেশে টাকা ওয়ালাদের বাড়ী দেখলেই সহজেই অনুমান করা যায় । অথচ জাপানে আবাসিক এলাকাগুলোতে বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ী বানাতে হয় । ইচ্ছা করলেই চাকচিক্য করানো যায় না এবং কেউ তা করেও না ।

জাপানি উৎসব গল্পে তিনি জাপানের বিভিন্ন দিবস সম্পর্কে ধারনা দিয়েছেন। উন্নতির যতোই চরম শিখরে পৌঁছুক না কেন জাপান যে এশিয়ার একটি দেশ তা তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির উৎসব পালনের দিকে নজর দিলেই যে কেউ আঁচ করতে পারবেন। যদিও বিশ্বের  বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতি বা কুসংস্কার রয়েছে এবং তা অনেকটাই অঞ্চলভিত্তিক । কিন্তু জাপানে সার্বজনীন ভাবে উৎসব পালন করা হয় । এলাকাভিত্তিক উৎসব অবশ্যই আছে জাপানে ।

“৭৪ জন শিশুর প্রাণের বিনিময়”  গল্প থেকে কোন প্রশাসন ( দায়িত্ব পালনকারী সর্বোচ্চ পর্ষদ ) যদি শিক্ষা নিতে পারেন তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক অঘটন থেকে রক্ষা পেতে পারবে শুধু মাত্র পূর্ব দিকনির্দেশনা জানার কারনে । ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন এই গল্পের মূল শিক্ষা ।

‘এক জাপানি মেয়ের কাছে ভালবাসার সংজ্ঞা নিয়ে লেখকের জানা ভালোবাসার সংজ্ঞা বাংলাদেশ এর প্রেক্ষাপট  থেকে, আর জাপানি মেয়ের ভালোবাসার সংজ্ঞা জাপান অভিজ্ঞতার আলোকে । এখানে দু’জনেই জয়ী । লেখকএর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘উইন উইন সিচুয়েসন’ । যদিও জাপান কাহিনি ৭ম খন্ডে তার প্রিয় শব্দ উইন উইন সিচুয়েসন মাত্র ২ বার ব্যবহার করেছেন ।

জাপান বাংলাদেশ প্রেম রহস্য’ পাঠক , রাজনীতিবিদ তো বটেই অনেক গবেষকদের জন্য তথ্য ভান্ডার হিসেবে কাজে আসবে নিঃসন্দেহে নিশ্চিত করেই বলা যায় ।

“জাপানি বক্সারের বিশ্ব রেকর্ড” তথ্য সমৃদ্ধ একটি সত্য ঘটনা । হাকামাদা কে নিয়ে ভবিষ্যৎ গবেষকদের কাজে লাগবে নিঃসন্দেহে বলা যায় । হাকামাদার এই ঘটনা নিয়ে আমি নিজেও বাংলাদেশের একাধিক জাতীয় পত্রিকায় লিখেছিলাম । তবে এতোটা তথ্য সমৃদ্ধ ছিলনা যতোটা পাওয়া যায় ডঃ আশিরের লেখনীতে ।

একই গল্পে তিনি তার পিতার অমুল্য বানী তুলে ধরেছেন -

একজন ইঞ্জিনিয়ার এর ভুলে কিছু অর্থ নষ্ট হতে পারে

একজন ডাক্তারের ভুলে একজন রোগী মারা যেতে পারে ।

একজন পলিটিশিয়ানের এর ভুলে একটা জাতি নষ্ট হতে পারে

আর , একজন বিচারক এর ভুলে ?

বিচারক এর ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে বক্সার হাকামাদাকে।  কি সেই মাশুল ?

হাকামাদা জীবনের ৪৬টি বছর= ১৬৩৭৬ দিন =১৪ লক্ষ ঘণ্টা = দেড় বিলিয়ন সেকেন্ড কেটে গেছে শুধু মৃত্যু ভয় নিয়ে।

জাপানে বিচারকরা সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে বিচার কার্য সম্পন্ন করে থাকেন । তারপরও অমার্জনীয় এই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে হাকামাদা কে। তবে , বিধাতার বিচার বলতে একটি কথা আছে । আছে “রাখে আল্লাহ , মারে কে ?” বলে চির প্রচলিত একটি প্রবাদ । হাকামাদা’র  ঘটনা যেনো তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।

 

‘স্বদেশ কাহিনী - বই পড়া’ পড়ে নিজের পুরানো একটি ঘটনা মনে পড়ে আজও হাসি পায় । ছাত্রাবস্থায় ক্লাসের পাঠ্য বইয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর “বই কেনা” গল্পে ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না’ বানীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জমানো অর্থ দিয়ে মাত্র ৫টি বই কিনে বেশ কিছুদিন অর্থ কষ্টে ভুগেছিলাম। যা মনে পড়লে আজও নিজের বোকামীর মাশুল ই মনে হয় ।

 

স্বদেশ কাহিনী – বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী গল্পে উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্স এর টগবগে যুবক ডাক্তারের সততা , নিষ্ঠা , কর্মস্পৃহা এবং নৈতিকতার বর্ণনা শুনে আশার আলো দেখতে পাই। তাদের মতো সৎ অফিসার আছে বলেই প্রিয় দেশটি এখনো দিক হারায়নি । এই গল্পে লেখকের প্রিয় এখলাসপুরের আতিথেয়তার কথা জানান দিয়েছেন তার স্বভাব সুলভ বর্ণনায় ।

 

পরবর্তী গল্পে জাপানী বয়োবৃদ্ধ দম্পতির আতিথেয়তায় তাদের শখের চাষ করা ফ্রেশ করল্লা এবং কলমি শাক প্রাপ্তির কথাও স্বীকার করেছেন । পৃথিবীর সব দেশের গ্রামের লোকজনই সহজ সরল এবং দিল দরিয়ার হয়ে থাকে । এই গল্পে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।

 

প্রবাসে বসবাস করলেও লেখক ডঃ আশির আহমেদ এর মন প্রান জুড়ে যে বাংলাদেশ এবং সুযোগ পেলেই যে তা তুলে ধরেন ‘২০৫০ সালের জাপান’ গল্প তার প্রমান। বাংলাদেশের শিশুদের নিয়ে লেখকের স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা অনেক সুদূরপ্রসারী । লেখকের অনেক কাজ-ই প্রত্যেক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে । সুযোগ পেলেই তিনি জাপানের মাটিতে বাংলাদেশ এবং প্রবাসী শিশুকিশোরদের পরিচিত করিয়েছেন এবং স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন । ২০৫০ সালের জাপান গল্পেও তিনি জাপান , আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড এর প্রফেসরদের মুখ থেকে প্রশংসা স্বরুপ “বাংলাদেশ ইনোভেশনের খনি” মন্তব্য আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন  ।

এছাড়াও, ‘কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড়’ , ‘প্রবাসীদের আয়ের টাকা’ , ‘সারভাইভেল’  , ‘এক জাপানি মেয়ের কাছে ভালবাসার সংজ্ঞা নিয়ে’ , ‘উঠতি উদ্যোক্তা’ , ‘ক্লাসে বাংলাদেশকে নিয়ে জাপানিদের প্রশ্ন’ গল্প গুলো থেকেও অনেক কিছুই শিখার আছে ।

২০১৫ তে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে  ডঃ আশির আহমেদ এর ‘জাপান কাহিনি’ প্রথম খণ্ড প্রকাশ পেলে বইটি নিয়ে আলোচনায় বলেছিলাম “জাপানকে জানার জ্ঞানকোষ হ’তে পারে ডঃ আশির আহমেদ এর ‘জাপান কাহিনি’’।

একে একে ২য় , ৩য় হয়ে এভাবে ৭ম খন্ড এসে বইটি পাঠের পর আজ বলতে ইচ্ছে করছে ‘ডঃ আশির আহমেদ এর জাপান কাহিনী পড়ুন, জাপান কে জানুন’।

আর এ এস/আর এ

"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখক নিজেই। টোকিও বাংলা নিউজ কোনভাবেই এই বিভাগে লেখক কিংবা ‌লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"