- শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

টোকিও শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর ফলক উধাও কার সিদ্ধান্তে?

রাহমান মনি

প্রকাশিত: ০২:০৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

টোকিও শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর ফলক উধাও কার সিদ্ধান্তে?

ক্ষমতার পালাবদলে নাম পরিবর্তন কিংবা মুছে ফেলার সংস্কৃতি বাংলাদেশের রাজনীতির নোংরা অংশ বিশেষ হলেও তার বহিঃপ্রকাশ কি বিদেশের মাটিতেও জানান দিতে হবে ? প্রতিহিংসার রাজনীতি এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও !

২০০৫ সালের ১২ জুলাই টোকিও'র তোশিমা সিটির ইকেবুকুরো পশ্চিম উদ্যানে (যেখানে টোকিও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বিদেশের মাটিতে প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে জাপান প্রবাসীরা গর্বের সাথে ২১ শে’র প্রভাতফেরি করে আসছে ।

১২ জুলাই ২০০৫ টোকিও'র তোশিমা সিটি মেয়র তাকানোর উপস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন এবং ২০০৬ জুলাই জাপানের তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রী, বর্তমান টোকিও গভর্নর কোইকে ইয়ুরিকো এবং বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী মেজর (অবসর প্রাপ্ত) কামরুল ইসলাম কর্তৃক উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে টোকিও শহীদ মিনার হয়ে যায় জাপান প্রবাসীদের গর্ব করার অন্যতম একটি বিষয়। দল-মত,ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা ও স্থানীয় প্রশাসন তোশিমা সিটি ও জনগনের আন্তরিক সহযোগিতা ও উদারতায় যে বাঙালী জাতির অহংকার শহীদ মিনারটি জাপানের মাটিতে স্থাপিত হয়েছিল একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের বাহিরে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। যার একজন সাক্ষী হিসেবে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।
 
৩১২৩,১৯ স্কয়ার মিটার আয়তন বিশিষ্ট টোকিও'র তোশিমা  সিটির  ইকেবুকুরো নিশিগুচি কোয়েন (যেখানে টোকিও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে)অবস্থিত শহীদ মিনার পাশেই রয়েছে টোকিও মেট্রোপলিটান আর্ট স্পেস। ১৯৭০ সালে পার্কটি  প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে পার্কটি'র বয়স আর বাংলাদেশের বয়স প্রায় সমান। যদিও তা কাকতলীয়।

সম্প্রতি পার্কের উন্নয়ন কাজের সুবিধার জন্য শহীদ মিনারটি  অনতিদূরে সরিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর আবার পুনঃস্থাপন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত,শহীদ মিনার ফলকটি আর শোভা পাচ্ছে না। ফলকটিতে ৩ টি ভাষায় ( বাংলা, ইংরেজী এবং জাপানিজ) সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ ছিল।

ইকেবুকুরো নিশিগুচিতে স্থাপিত শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর ফলকে যে খালেদা জিয়ার নাম থাকছেনা তার কানাঘুষা চলছিল বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ২য় বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। ২০১৪ সালের পর তা বেগবান হচ্ছিল। কিন্তু সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে ২০১৮ সালে আসে সে মোক্ষম সময়। ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্ক-এর সৌন্দর্য বৃদ্ধির উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ বছরের জন্য বন্ধ রাখা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে শহীদ মিনারটি অস্থায়ীভাবে সরানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে । যেহেতু জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট তাই, সঙ্গত কারনেই মন্ত্রণালয় থেকে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয় বলে সুত্র মতে জানা যায়। সেই সময়ে রাষ্ট্রদূত ছিলেন রাবাব ফাতেমা (বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত)।  দূতাবাস থেকে ফলকটি ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয় বলে প্রবাসীদের মাঝে চাউর হয় এবং বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় বলে প্রবাসীরা মনে করেন ।

কেহবা মনে করেন, রাষ্ট্রদূতের একক সিদ্ধান্তে ফলক ভাঙ্গার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় এবং দূতাবাসকে আড়াল রাখা হয়।পরবর্তীতে জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি নিয়োগ এই সন্দেহকে আরও বেগবান করে। সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির জাপান সফর । তবে এর পক্ষে জোরালো কোন তথ্য নেই।

২০১৯ সালের নভেম্বর রাবাব ফাতিমা জাপানে রাষ্ট্রদূতের পাঠ চুকানোর প্রাক্কালে ৯ নভেম্বর টোকিও'র একটি রেস্তোরায় প্রবাসীদের একটি অংশ বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে রাবাব ফাতেমাকে বিশেষ বিশেষ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে বিদায়লগ্নেও তিনি শহীদ মিনার নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নি।
তবে যে বা যারা -ই জড়িত হউন না কেন, অতি উৎসাহীদের উৎসাহে জঘন্যভাবে ইতিহাস বিকৃতির পাঁয়তারায় যে কাজটি করা হয়েছে তা বুঝতে পন্ডিত হতে হয় না। যদিও দূতাবাস সংশ্লিষ্ট নির্ভর যোগ্য সুত্রে জানা যায় , ফলক ভাঙার ব্যাপারে দূতাবাসের কোন হাত নেই বা দুতাবাসের সাথে কোন যোগাযোগ করা হয়নি; কিন্তু দেশপ্রেমী প্রবাসীরা তা মেনে নিতে পারছে না বরং ক্ষুব্ধ এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে ।  বিশেষ করে একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা মনে করে, খালেদা জিয়ার নাম মুছে ফেলার জন্য কাজটি করা হয়েছে। তাদের সন্দেহের তীর সরকারের দিকে।

প্রবাসীরা মনে করছে এটা প্রতিহিংসা। তারা জানতে চায়, কেনো এই প্রতিহিংসা? খালেদা জিয়ার নাম থাকলে সরকারের কি খুব বেশী ক্ষতি হতো? সরকার পড়ে যেতো? ফলকের উপরে তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার নাম ছিল। বিএনপি’র চেয়ারপারসন হিসেবে নয়।জাপানীরা সরকারী দল কিংবা বিরোধী দল বুঝে না। তারা চিনে বাংলাদেশ।

জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে যাই ঘটুক না কেন, দূতাবাসের হস্তক্ষেপ ছাড়া ফলকটি পুনঃস্থাপিত যে হবে না; একথাটি সকলেরই জানা। তাই, দূতাবাসের স্বদিচ্ছা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে এবং প্রবাসীদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে অনতিবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে ফলকটি পুনঃস্থাপন করার জোর দাবী জানাই। মনে রাখতে হবে, সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন না।  আল্লাহ্‌ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।  মনে রাখতে হবে, প্রতিহিংসার রাজনীতি কল্যাণ বয়ে আনে না।

ফলকটিতে শহীদ মিনার কি এবং কেন, তার বিবরণ তিনটি ভাষায় (বাংলা,ইংরেজী এবং জাপানীজ ) ভাষায় উল্লেখ ছিল যা পড়ে পর্যটকরা সহজে আমাদের দেশে ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে এবং এই মিনার সম্পর্কে সহজে জানার সুযোগ পেতো।

 

রাহমান মনি

জাপান প্রবাসী সাংবাদিক   
[email protected]

আর এ

"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখক নিজেই। টোকিও বাংলা নিউজ কোনভাবেই এই বিভাগে লেখক কিংবা ‌লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"