কাতার বিশ্বকাপ অঘটনের নয়,যোগ্যতার,সাফল্যের এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত।কতো গুণীর কতো অভিমত আছে আমার নিজেরও কিছু মতামত।তবে শুরুতেই বলে রাখি,বিশ্বকাপ বুঝে দেখি আমি ৮৬'র মেক্সিকো বিশ্বকাপ থেকে।আর সবকিছু মিলিয়ে আমার দৃষ্টিতে এবারের কাতার বিশ্বকাপই সবচেয়ে সেরা এবং উপভোগ্য।অবশ্য এ আমার একেবারেই ব্যক্তিগত অভিমত।
এবার আসি মত আর অমতে।এবারের বিশ্বকাপ আয়োজনের শুরু থেকেই কাতারের সামর্থ্য,যোগ্যতা আর যৌক্তিকতা নিয়ে নিন্দুকদের একদল সরব ছিলো।তাদের ভাষ্য,কাতার নাকি ঐতিহ্যের যোগ্যতায় নয়,পেট্রোডলারের জোরে হয়েছে এবারের আয়োজক।
যদি তা সত্যিও হয়, নগদনারায়ণ নিয়ে কে বা কারা তাদের দিয়েছে সে সুযোগ,তা নিয়ে কিন্তু কারও রা নেই।সবার মুখে কুলুপ।আমিও চুপ থাকি।কারণ, এখানে আমার আলোচ্য বা বিবেচ্য বিষয় তা নয়।
তারচেয়ে আমি বলি,তাতে ক্ষতি কি!কাতার তো তার আর্থিক সামর্থ্য পৃথিবী ধ্বংসের আর বনি আদম নিধনের মারণাস্ত্রে ব্যয় করেনি।করেছে বিশ্বসেরা খেলাটির বৈশ্বিক আয়োজনে।তাদের নির্মিত দৃষ্টিনন্দন, বিলাস আর ব্যয়বহুল স্টেডিয়াম গুলোর কথা এখানে থাক।কারণ প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বকাপ শুরুর বহু আগে থেকেই বিশ্ববাসী তা জানে।
সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।সাধারণের আবরণে ঐতিহ্য প্রদর্শনীর যে অসাধারণ নিদর্শন এবার তারা দেখিয়েছে,এককথায় তা অভূতপূর্ব।অনমনীয় দৃঢ়তায় আর অপূর্ব নান্দনিকতায় কাতার দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে স্বদেশীয় কৃষ্টি আর কালচারকে নিজেদের মতো করে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হয়।বিশ্বকাপ উপলক্ষে এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পুরো নগরীর নজরকাড়া, মস্তিষ্কে দোলা দেওয়া ভিন্ন আঙ্গিকের সাজসজ্জাও ছিলো তেমনি চমকপ্রদ।
কাতার মুসলিম দেশ।তবুও ইসলামি কালচার শব্দটি এখানে আমি পরিহার করলাম এমনিতেই যারা নাচুনি বুড়ি,তাদের আবার ঢোলের বাড়ি না দিতে।বলার অপেক্ষা রাখেনা,কাতারের এমন সাহসী আর জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ বিশ্ববাসীর নিন্দাবাদ নয়,বরং সাধুবাদ কুড়িয়েছে।
এবার আসি তথাকথিত বুর্জোয়া দলগুলোর ভাষায় যারা ছোটদল,তাদের এবারকার চমকপ্রদ নৈপুণ্য আর অভাবনীয় সাফল্যের কথায়।প্রশংসার বদলে কেউ বাংলায় বলছে এ বিশ্বকাপ নাকি অঘটনের!আবার কেউ ইংরেজিতে বলছে আনপ্রেডিক্টেবল।আমি বলি না।বরং বলি,এটাই রিয়্যালিটি।দুর্বল তো আর সারাজীবন দুর্বল থাকেনা।সবাইকে সবসময় দাবিয়ে রাখা যায়না।
সৌদিআরব,ইরান,জাপান,কোরিয়া,সেনেগাল,ঘানা আর মরক্কো এবার যে নৈপুণ্য দেখিয়েছে,আমি বলি তা অঘটন নয়।বরং তাদের প্রত্যাশিত সাফল্য,যা আমাদের সীমিত পরিসরের ভাবনায় অপ্রত্যাশিত।কারণ, আমাদের এযাবৎ কালের ভাবনার দৌড়ে সেরার তালিকায় তো সবসময় ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা,ফ্রান্স আর জার্মানি।এরবাইরে এতোদিন যাদের আমরা গোনায় ধরেছি,তার সবই ইউরোপিয়ান আর ল্যাটিন দল।ফুটবলের বিশ্বশক্তিই তো আমাদের ভাবনায় ল্যাটিন আর ইউরোপিয়ান।এশিয়া আর আফ্রিকা কোটার জোরে এতোদিন বিশ্বকাপে যা খেলেছে,তা আমাদের কাছে ছিলো গতানুগতিক।কিন্তু ইতিমধ্যে তারা ফুটবলে যে এতোদূর এগিয়ে গেছে,তা আমাদের গোচরে ছিলোনা। এবারের আসরে তাই তাদের ধাক্কাটা আমদের শুধু চোখেই লাগেনি,চোখ কপালেও তুলেছে।তাদের কাছে প্রায় সব খানদানি আর বনেদী দলগুলোর কুপোকাতকে আমাদের কাছে অঘটন মনে হয়েছে।
মরক্কো,জাপান,কোরিয়া, সেনেগাল এবারই শিরোপা জয়ের দোরগোড়ায় যাবে,এ আমি এখনও ভাবিনা।তবে সেদিনও এখন আর বেশী দূরে মনে হয়না,যেদিন এদের যে কারোরই মাথায় ফুটবলে বিশ্বসেরার মুকুটটি শোভা পাবে।
সবশেষে বলি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে ঘিরে আমাদের যে উন্মাদনা,তা নিয়ে।এ দুটি দলের সমর্থকে বিভক্ত হয়ে আমরা যা করছি, তা শুধু পাগলামি নয়; রীতিমতো বাড়াবাড়ি, আপত্তিকর এবং বিরক্তিকর।দীর্ঘদিনের কলোনিয়াল শাসনের এফেক্টে এমনিতেই আমরা স্বদেশী ঠাকুর ফেলে বিদেশী কুকুর ভক্তিতে অধিক পারঙ্গম।অবশ্য আমাদের ফুটবল প্রীতির বেলায় এ কঠিন কথাটি প্রযোজ্য নয়।নিঃসন্দেহে আমরা ফুটবল প্রিয় জাতি।তারপরও বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে আমরা যে পরিমাণ বাড়াবাড়ি করি,তাতে মনে হয়,আমরা ভালো খেলা বা ভালো দলের নয়,ওই দুটি দলের অন্ধ সমর্থক।
প্রিয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে শোভাযাত্রা,নাচাগানা আর বাকযুদ্ধ নাহয় মেনে নিলাম।কিন্তু নিজ দেশের আকাশে- বাতাসে যে পরিমাণ ভিনদেশী পতাকা উড়ানো হয়,তাকে রাষ্ট্রদোহ বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ যদি নাও বলি,তা কি শোভন?সমর্থনযোগ্য?আমার তো আশংকা হয়,ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা যদি ফাইনালে যায়;জয়পরাজয়ের পর বিদেশে বা ওদের দেশে নয়,এই বাংলাদেশেই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ বেঁধে যাবে।
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রিয় দলের জন্যে আমাদের দর্শকদের এই যে উন্মাদনা, যদি একে ভালোবাসা বলে মানিও,বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কবে খেলবে,সুদূর কল্পনাতেও কি আমরা কেউ তা জানি?জানিনা।কারণ আমাদের দর্শক-সমর্থকরা যতোটা ফুটবল পাগল,খেলোয়াড়রা ততোটা না।ফুটবল আর ফুটবলারদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা,ভাগ্যবিধাতারা তো একেবারেই না।
একারণেই তো যে বাংলাদেশ আশির দশকেই এশিয়া কাপ মাতিয়েছে,সে বাংলাদেশ এখন সাউথ এশিয়ার প্রায় সব দলের কাছেই নাকাল।ফিফা র্যাংকিং এ বাংলাদেশের অবস্থান এখন কততম,তা আমি লজ্জায় এখানে বলতে পারলাম না।কিন্তু আমি নিশ্চিত,জানে তা সবাই।যদি কেউ নাও জানে, তবে তা জানা যায় নিমিষেই।কারণ,প্রযুক্তির কল্যাণে তথ্য এখন শুধু আমাদের হাতের মুঠোয় নয়,বলা যায় বুড়ো আঙুলের তলায়।
আর সি
"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখক নিজেই। টোকিও বাংলা নিউজ কোনভাবেই এই বিভাগে লেখক কিংবা লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"