- সোমবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ১৬ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

মানুষের জীবন নিয়ে নগ্ন বাণিজ্য আর কতো ! 

নাজমুল ইসলাম মকবুল

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ৩০ নভেম্বর ২০২১

মানুষের জীবন নিয়ে নগ্ন বাণিজ্য আর কতো ! 

ছবি:টোকিও বাংলা নিউজ

সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগী নিয়ে যাই ডাক্তার দেখানোর জন্য। ২৭ নভেম্বর ২০২১ শনিবার সকাল দশটার দিকে। হাসপাতালের বর্হিবিভাগে রোগী দেখানোর পর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হতেই একজন লোক এসে প্রেসক্রিপশনটা তার হাতে দেবার জন্য বললে জিজ্ঞেস করলাম কি জন্য? বললেন একটু দেখবেন এবং সেটার ছবি তুলবেন। আমি বললাম কেন? লোকটি আমতা আমতা করতে লাগলেন। বললাম আপনি কি করেন। উত্তরে বললেন স্কয়ার ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। বললাম আপনার পরিচয়পত্রটা একটু দেখান। আমি আপনার একটা ছবি তুলতে চাই। বলার সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে উদ্যত হলে লোকটি দৌড়ে পালালেন। 

এরপর আরেকটি ডিপার্টমেন্টের আরেকজন ডাক্তারকে ওই রোগী দেখানোর পর বের হবার সাথে সাথে আরেকজন লোক এসে সামনে হাজির। উনিও চাইলেন আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা। বললাম কি করবেন। বললেন একটু দেখবো এবং একটা ছবি তুলবো। বললাম তোমার নাম কি। উত্তরে বললেন শাহিন। বাড়ী কোথায়। বললেন রংপুর। কি করেন। ঔষধ কোম্পানীতে চাকরি করি। বললাম পরিচয়পত্রটা একটু দেখান। বললেন সাথে নেই। বললাম তাহলে ভিজিটিং কার্ডটা একটু দেখান। কাচুমাচু  খেয়ে বললেন স্যার সাথে নেই। শেষ হয়ে গেছে। আমি বললাম রোগীদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের (প্রেসক্রিপশনের) ছবি তোলে বিক্রি করো। এটা কোন ধরনের ব্যবসা। কোন ধরনের চাকরি! কথা বলতে বলতে লোকটির কয়েকটি ছবি তোললাম। দেখলাম এ ধরনের অনেক লোকই ওই হসপিটালের বাইরে ঘুর ঘুর করছে এবং রোগীরা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই প্রেসক্রিপশনটা ছো মেরে নিয়ে ছবি তোলে আবার ফেরত দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। 

আরেকজন এসে বলল ‘ক্লিনিকো ভর্তি অইতানি’। লোকটির দিকে একটু তীখ্ন  নজরে চাইতেই সটকে পড়লো। 
কয়েকমাস পূর্বে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিকটে একজন ডাক্তারের চেম্বারে আমার মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেছিলাম পরামর্শের জন্য। বের হতেই একজন লোক আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা নিতে চাওয়ায় আমি বললাম কিজন্য। লোকটি বললেন একটা ছবি তুলবেন। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতেই ওই লোকটাও সটকে পড়লেন কৌশলে। 
প্রায় তিন বছর পূর্বে সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখানোর পর বের হতেই এমন কয়েক ডজন লোক দেখতে পাই অপেক্ষমান। সবাই বলতে থাকে আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা তাদেরকে দেখাতে। তীক্ষè নজরে চাইতেই তারা ইতস্তত করতে লাগলেন। একজন লোক আমার পেছন পেছন কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত এসে আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা চাইলে বললাম কিজন্য! লোকটি বললেন একটু দেখার জন্য। বললাম আমার প্রেসক্রিপশন এটাতো আমার ব্যক্তিগত জিনিস। এটা তুমি দেখার কে? এই বলে যখন ওই লোকটির ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করতে পকেটে হাত দিলাম তখনই লোকটি দৌড়ে পালালো। 
এটা শুধু সিলেট শহরে নয়। আমাদের বিশ^নাথেও বিভিন্ন ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে আবার অনেক ফার্মেসীতেও এ ধরনের লোক ওৎ পেতে থাকে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই বা ফার্মেসীতে ঔষধ কিনতে গেলেই প্রেসক্রিপশনটা দেখতে এবং ছবি তোলতে চায়। 

কারন নির্ণয় করার জন্য বিভিন্নজনের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়ে তাদের মতামত চাইলাম। অনেকেই বললেন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী কতিপয় অসাধু ডাক্তারের সাথে নাকি চুক্তি করে তাদের কোম্পানীর ঔষধ বেশি করে লেখার জন্য। তাদের উৎপাদিত ঔষধ চালানোর টার্গেট দিয়ে সে অনুযায়ী নাকি অঢেল টাকা, বাসায় দামী ফার্নিচার, এসি, আইপিএস, ফ্রিজসহ মুল্যবান সামগ্রী। এমনকি ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর শাড়ী, গয়না, অলংকারসহ পছন্দের জিনিস নাকি উপহার দেয়। এছাড়া গাড়ী, বাড়ি বা ফ্ল্যাটও নাকি উপহার দেয়। স্বামী-স্ত্রীসহ পুরো পরিবারের বৈদেশ ভ্রমণের টিকেটসহ সকল খরচও নাকি থাকে কোন কোন অফারে। এসব উপঢৌকন দেবার পর তারা লোক নিয়োগ করে তাদের ঔষধ কয়টা লিখতেছেন তা মনিটর করার জন্য। 
আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে! এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় ঔষধ কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরাও তাদের দেয়া উপঢৌকনসামগ্রী যেসব অসাধু ডাক্তারদের দেন তাদের বিশ^াস পর্যন্ত করতে পারেননা। এই অবিশ^াসের কারণেই বাহিরে বেতনধারী বা কমিশন ভিত্তিক পেয়াদা নিয়োগ দিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে হয়তো নেয়া হয় পরবর্তী পদক্ষেপ। এ ধরনের বিশ^াস অবিশ^াসের দোলাচলে সহজেই অনুমেয় যে আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি।  

কয়দিন পূর্বে একটি টিভি চ্যানেলের খবরে দেখছিলাম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকল ঔষধ বিক্রির সচিত্র প্রতিবেদন। ঔষধগুলোর লেভেল এক্কেবারে আসল ঔষধের মতো। পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়া আসল নকল বুঝা মুশকিল। নকল ঔষধগুলো আসল ঔষধের তুলনায় কয়েকগুণ কম দামে বিক্রয় করে ফার্মেসী মালিকদের কাছে। অসাধু ফার্র্মেসী মালিকরা এসব নকল ঔষধ কম দামে পেয়ে দারুন খুশি। বিক্রি করেন জীবন রক্ষাকারী আসল ঔষধের দামে। মরলে মরুক পাবলিক কিন্তু নিজের লাভ কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা দারুন খুশি।

অনেক ডাক্তার রোগী দেখার পূর্বেই কাংখিত ভিজিটটা নিয়ে নেন। পরে রোগী দেখেন। ঔষধ দু-একটা প্রয়োজন হলেও লেখেন ১০ থেকে ১৫ টা। অনেকে প্যাড খালি রাখতে নারাজ। লিখতেই থাকেন। কারন ঔষধ কোম্পানীর সাথে লেনাদেনার শোধ করতে হবে আম পাবলিককে জমের গাতে দিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ সেবনে রোগীর বারোটা বাজলেও তাদের যেন কোন মাথাব্যথা নেই। আবার অনেকে প্রেসক্রিপশনে ঔধষের নাম লিখতে এমন লেখা উপহার দেন যা পড়া বা তার মর্ম উপলব্ধি করা মুশকিল হয়ে পড়ে। যে যতো অপটনযোগ্য হিজিবিজি লেখা লেখতে পারেন, তিনি নাকি তত বড়ো মানের ডাক্তার। 

তবে হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয়, ডাক্তার মহোদয়গণের মধ্যেও সকল ডাক্তার সমান নয়। আমাদের সিলেট তথা বাংলাদেশে অনেক অনেক মানবিক ডাক্তারও আছেন, যারা টাকা পয়সার তোয়াক্কা না করে মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে। অনেক মানবিক ডাক্তাররা ফ্রি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন এমনকি রোগীদের ফ্রি ঔষধপত্রের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছেন। যারা ফি দিতে অপারগ তাদের ফ্রি তে দেখছেন। অনেকে অর্ধেক ফিতেও রোগী দেখছেন। শুধু চিকিৎসা সেবা নয়; মানুষের যে কোন বিপদ আপদেও তারা সহযোগিতা করছেন। এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

সহযোগিতা করে যাচ্ছেন দুহাত খুলে প্রকাশ্যে কিংবা অগোচরে সওয়াবের নিয়তে। অনেক মানবিক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসাসেবার জন্য গেলে জোর করেও ফি দেয়া সম্ভব হয়না। তারা হাসিমুখে সেবা দেন, প্রাণখুলে দোয়াও দেন। তাদের এসব কার্যক্রম দেখলে এবং তাদের সান্নিধ্যে গেলে মনে প্রশান্তি আসে, মন তৃপ্ত হয়। আত্মা শান্তি পায়। এ ধরনের অনেক মানবিক ডাক্তার আছেন এবং পরলোকগত হয়েছেন। যাদের নাম গরিব অসহায় মানুষের হৃদয়ে আছে অংকিত। তাদের প্রশংসা সকলের মুখে মুখে। দোয়া পাচ্ছেন সবসময়। 

আরেকটি বিষয় আমাদের নজরে আসে বিভিন্ন সময়। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে নাকি বিশ থেকে চল্লিশ পার্সেন্ট কমিশন দেয়া হয় কিছু অসাধু ডাক্তার সাহেবদের। যারা রোগী পাঠান তাদেরকেই মুলত এসব কমিশন দেয়া হয়। অনেকে বলেন কমিশন পাওয়ার জন্য নাকি বিভিন্ন অসাধু ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করান। তাদের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা না করালে এসব তারা দেখেননা বা উষ্মা প্রকাশ করেন বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। আবার অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রিপোর্টের আগে থেকেই টেকনিশিয়ান বা ডাক্তারের স্বাক্ষরসহ সিল মেরে রাখা হয় এবং অনুমাননির্ভর রিপোর্ট দেয়া হয় বলে অনেকে অভিযোগ করেন।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো বিভিন্ন ক্লিনিকেও রোগীকে পাঠালে নাকি কমিশন পাওয়া যায়। প্রয়োজন ছাড়া সিজার বা রোগী বা তাদের স্বজনদের নানা ধরনের ভয় ভীতি দেখিয়ে নাকি অপারেশনে বা আইসিইউতে থাকতে বাধ্য করা হয়। এতে নাকি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের লাভ এবং রেফারকারীরও লাভ। অনেক সরকারী হাসপাতালে আবার কতিপয় ডাক্তারের ব্যবহার থাকে একরকম আবার প্রাইভেট চেম্বারে ভিন্নরকম। আবার অনেকে সরকারী চাকুরী করলেও নির্ধারিত ডিউটি বাদ দিয়ে বা সংক্ষিপ্ত করে ডিউটি করতে শুনা যায় নিজের প্রাইভেট চেম্বারে বা প্রাইভেট হসপিটালে। 

বেশ কয়েকবছর যাবত বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর নানা ধরনের ব্যবসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা দেখতে দেখতে এসবে আমাদের যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। মানবিক কারনে ও জীবন রক্ষার তাগিদে বিষয়টি মিডিয়াকর্মীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আরও বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল। পাশাপাশি যেসব দালালরা রোগীদের ব্যক্তিগত প্রেসক্রিপশন ছো মেরে নিয়ে ছবি তোলে বাণিজ্য করে মোবাইল দিয়ে ওদের ছবি তোলে সাংবাদিক বন্ধুদের সরবরাহের পাশাপাশি সোসাল মিডিয়ায় প্রচারের এবং ওদের আইন শৃঙখলা বাহিনির হাতে সোপর্দ করার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে আরও।

 

নাজমুল ইসলাম মকবুল

সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম

আর এ/আর এ এস

"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখক নিজেই। টোকিও বাংলা নিউজ কোনভাবেই এই বিভাগে লেখক কিংবা ‌লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"