- শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

| পৌষ ৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

আরিফ মোহাম্মদ একজন সফল কূটনীতিক এর বিদায়

রাহমান মনি

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

আরিফ মোহাম্মদ একজন সফল কূটনীতিক এর বিদায়

সাধারণত দূতাবাস এবং প্রবাসীদের মধ্যে সম্পর্কটা শীতল থাকে। প্রবাসীরা মনে করেন, দূতাবাস তাদের জন্য কিছুই করেন না। এসব আমলারা কেবল বসে বসে বেতন নেন । প্রবাসীদের জন্য কোন কাজ করেন না ।  তাই , দূতাবাসের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের অভিযোগের শেষ নেই।

তবে, দূতাবাসের কাছে প্রবাসীদের চাহিদা কিন্তু তেমন বড় কিছুই না। কেউ চাকরি, ব্যবসা, বাসস্থান বা আহারের জন্য দূতাবাসে সাধারণত ধরনা দেন না একেবারেই বিপদে না পড়লে । প্রয়োজনীয় সনদ সত্যায়িত, পাসপোর্ট বিষয়ক কাজ ছাড়া সাধারণত দূতাবাসে কেহ যানও না

আবার দূতাবাস মনে করে প্রবাসীদের জন্য কাজ করতে করতে তারা পেরেশান । তবুও তাদের মন জয় করতে পারেন না । দূতাবাসের চোখে প্রবাসীরা হচ্ছেন কামলা । এই আমলা এবং কামলার সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়ার মতো ।

এত কিছু সত্ত্বেও কিছু কিছু আমলা বা সৎ অফিসার আসেন যারা সত্যিকার অর্থেই দেশের স্বার্থে যোগ্যতা বজায় রেখেই কাজ করেন এবং নিজ যোগ্যতায় প্রবাসীদের মন জয় করে তাদের হৃদয়ে স্থান করে নেন । প্রবাসীরাও ওইসব অফিসারকে খুব আপন করে নেন।  তাদের চলে যাওয়ায় প্রবাসীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। চোখে জল আসে। এ যেন যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। তেমনি এক অফিসারের নাম আরিফ মোহাম্মদ । বর্তমানে দূতাবাসের প্রথম সচিব ( রাজনৈতিক ) এবং দুতালয় প্রধান। অত্যন্ত মেধাবী এবং চৌকস এই অফিসার সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে টোকিওস্ত  বাংলাদেশ দূতাবাস ছাড়ছেন।

আগামী বছরের শুরুতে তিনি ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে সহকারী হাই কমিশনার হিসেবে যোগ দিবেন।  ৪ জানুয়ারি নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে তিনি জাপান ত্যাগ করবেন।

সেখানে তিনি বর্তমানে কর্মরত সহকারী হাই কমিশনার মোহাম্মদ জোবায়ের হোসেন এর স্থলাভিষিক্ত হবেন । আগামী ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে সহকারী হাই কমিশনার হিসেবে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।

আগরতলা হাই কমিশনে বর্তমানে কর্মরত সহকারী হাই কমিশনার মোহাম্মদ জোবায়ের হোসেনও ইতোপূর্বে টোকিও দুতাবাসে প্রথম সচিব এবং দুতালয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

 আরিফ মোহাম্মদ ৩১তম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিনান্স-এ বিবিএ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক বিজনেস-এ এমবিএ শেষ করে  টোকিওতে ন্যাশনাল গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ ( জিআরআইপিএস বা GRIPS ) থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ।

 ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগদান করেন । এর আগে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ।   বহি;বিশ্বে একজন কূটনীতিক হিসেবে জাপানেই তার প্রথম নিয়োগ পান এবং এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে  দুতালয় প্রধান সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  দায়িত্ব পালন করার পুরস্কার হিসেবে তার এই পদোন্নতি ।

তার মতো দক্ষ, পরোপকারী কূটনীতিক খুব কম-ই এসেছেন জাপানে। তিনি দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কথা শুনেছেন এবং সকলের জন্য সমানভাবে কাজ করে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। সব কূটনীতিককেই প্রবাসীরা বিদায়ী সংবর্ধনা দেন না, আবার যারা ভালো কাজ করেন তাদের দিতে কার্পণ্যও করেন না।

 ইতিপূর্বে আল্লামা সিদ্দিকী, জসীম উদ্দিন, মনিরুল ইসলাম, মনসুর ফায়জুল্লাহ, নাজমুল হুদা, মাসুদুর রহমান কূটনীতিক হিসেবে প্রবাসীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। বিদায় বেলায় প্রবাসীরা তাদের অন্তর নিংড়ানো ভালবাসা জানিয়েছিল।  তার সর্বশেষ সংযোজন ছিলেন শাহনাজ রানু । রাষ্ট্রদূতদের কথা অবশ্য ভিন্ন । তারপরও সব রাষ্ট্রদূতকে প্রবাসীদের  পক্ষ থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হয় না, কিছু কিছু রাষ্ট্রদূতকে দেয়া হয়।

টোকিও দূতাবাসকে বলা হয় বাংলাদেশী কূটনীতিকদের স্বর্গ । এখানে কাজ করতে পারাটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের । কেননা এখানে কাজের দক্ষতা দেখাতে পারলে পদোন্নতি খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা । তৃতীয় সচিব হিসেবে যোগ দিয়ে মাত্র ২ বছরের মধ্যে প্রথম সচিব হয়ে প্রস্থান করেছেন এমন নজিরও রয়েছে এখানে ।

 বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশ মিশনগুলির  মধ্যে টোকিও একমাত্র দূতাবাস যেখান থেকে পর পর দুইজন জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ( আব্দুল মমেন এবং রাবাব ফাতিমা )  নিয়োগ পান  এবং এখানে কাজ করে দুইজন সরকারী চাকুরী জীবনের সর্বোচ্চ পদ ‘সচিব’ পদে ( প্রয়াত মিজারুল কায়েস এবং বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব আব্দুল মোমেন ) উন্নীত হন।  এছাড়াও এখানে কাজ করে বর্তমানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন জসিম উদ্দিন ( রাস্ত্রদুত, ষ্টেট অফ কাতার ) এবং মাসুদুর রহমান ( হাই কমিশনার , নাইজেরিয়া ) ।

প্রবাসীদের পক্ষ থেকে  আরিফ মোহাম্মদকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়ার আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও করোনার এই মহামারির কারনে এবং জাপান সরকারের বিভিন্ন বিধি নিষেধ এর কারনে তা সম্ভব হচ্ছে না।

দুতাবাসে কর্মকালীন সময়ে আরিফ মোহাম্মদ এর অনেক ভালো কাজের মধ্যে একটির উদাহরণ দিয়ে লিখার সমাপ্তি টানতে চাই ।

২০০৪ সাল থেকে জাপান প্রবাসীদের দাবীর মুখে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোরশেদ খান প্রবাসীদের সেবা নেয়ার সুবিধার্থে মাসের প্রথম রোববার দূতাবাসের কনসুলার বিভাগ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেন। সেই থেকে টোকিওস্ত বাংলাদেশ দুতাবাস মাসের প্রথম রোববার প্রবাসীদের জন্য খোলা রেখে বিভিন্ন সেবা প্রদান করে আসছে।

সেই হিসেবে ৭ জুলাই '১৯ রোববার দুতাবাস খোলা রাখা হয় এবং যথারীতি প্রবাসীরা সেবা সংগ্রহে দূতাবাসে যান। তবে , উপস্থিতি সংখ্যাটা ছিল অনেক বেশী। তিন শতাধিক এবং সেবা প্রদানকারীদের সংখ্যা ছিল ৩/৪ জনের মতো । সেই সাথে কাউন্টার ছিল মাত্র একটি। ঘোষণা দেয়ার মনিটরও কাজ করছিল না।  স্বাভাবিক ভাবেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সেবা প্রদানকারীদের। সার্ভার এর ধীর গতির কারনে শিশুদের ছবি নিতে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় নিচ্ছিল অনেক ক্ষেত্রে।

এক পর্যায়ের সংকুলান না হয়ে করিডোর পেড়িয়ে দূতাবাস চত্বরে অবস্থান নিতে হয় অনেককেই । বৈরী আবহাওয়ার কারনে প্রবাসীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের । ফরম পূরণ করার জন্য একটু শুকনো স্থান পেতে অনেককে আবার সিঁড়ির নিচে গিয়ে লিখতে হয়েছে।

এমতাবস্থায় দুতালয় প্রধান ও প্রথম সচিব আরিফ মোহাম্মদকে ফোন করে প্রবাসীদের দুর্ভোগ লাঘবে ব্যাবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম খুলে দেয়া সহ কর্মকর্তা বাড়ানো সহ বসার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হলে, দুতালয় প্রধান রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে সবগুলো দাবী মেনে নিয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা নেন । খুলে দেয়া হয় মূল ভবনের ওয়েটিং রুম, বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম , ২য় তলায় নামাযের স্থান , ভিসা প্রদানের কাউন্টার ।  কাউন্টার ও বাড়ানো হয় । ২টা পর্যন্ত দুতাবাস খোলা থাকার কথা থাকলেও বিকেল পর্যন্ত সেবা প্রদান করা হয়।

এইদিন ২০১৬ সালে ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান-এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বর্ষ পালনের পূর্ব নির্ধারিত একটি শোক সভায় সকল কর্মকর্তাদের অংশ নেয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতির কারনে দুইজন কর্মকর্তা প্রবাসীদের সেবা দানে নিয়োগ থাকেন।

এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত নিচে নেমে এসে পরিস্থিতি অনুধাবন করে নিজে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সেবা প্রদানসহ দিক নির্দেশনা দেন এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের উদ্ভুদ্ধ করেন। একে একে ইকোনমিক মিনিস্টার ডঃ সাহিদা আকতার, কাউন্সেলর ডঃ জিয়াউল ইসলাম, প্রথম সচিব বেলাল হোসেন ,দুতালয় প্রধান ও প্রথম সচিব আরিফ মোহাম্মদ সহ অন্যান্য কর্মকর্তা এবং সহকর্মীরা তাদের নির্ধারিত সময়ের বাহিরে অতিরিক্ত সময় কাজ করে পরিস্থিতি সামাল দেন।

রাষ্ট্রদূতকে কাছে পেয়ে প্রবাসীরা তাদের দুর্ভোগের কথা ভুলে উল্টো রাষ্ট্রদূতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেন। একজন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক এই ব্যাপারে সেবা পাওয়াটা ছিল প্রবাসীদের ধারনার বাইরে। সেবা দেয়ার পাশাপাশি আগামীতে দুর্ভোগ লাঘবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা ।

উদ্যোগ গুলোর মধ্যে ফ্রি ওয়াই ফাই ব্যবহার , ফটোকপি মেশিন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার সুবিধা, ভেন্ডিং মেশিন এবং এ,টি,এম ব্যবস্থা প্রধান । এই ব্যাপারে জানতে চাইলে দুতালয় প্রধান ও প্রথম সচিব মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমরা অনেক উদ্যোগ নিতে চাইলেও জাপান সরকার এবং স্থানীয় এলাকার বাধ্যবাধকতার কারনে অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেনা অথবা সময় লেগে যায়।

এই ছিল টোকিও দুতাবাসের একজন মেধাবী এবং দক্ষ কূটনীতিকের  অসংখ্য ভালো কাজের মধ্যে একটি। 

 

রাহমান মনি

জাপান প্রবাসী সাংবাদিক   
[email protected]

আর এ/আর এ এস

"এই বিভাগে প্রকাশিত মুক্তমতের সকল দায়ভার লেখক নিজেই। টোকিও বাংলা নিউজ কোনভাবেই এই বিভাগে লেখক কিংবা ‌লেখার বিষয়বস্তুর দায়ভার নিচ্ছে না।"