ছবিঃ টোকিও বাংলা নিউজ
জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের বাইরেও লোডশোডিং এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগনকে যেতে হচ্ছে। এ অবস্থার জন্য বিদ্যুত উৎপাদনের ঘাটতিকে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে। এ সমস্যা সমাধানে জ্বালানি ও বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীকে সরাসরিভাবে সময় চাইতেও দেখা গেছে।
এদিকে বিশ্ববাজারে দাম চড়া। তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। দেশে কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহ। রান্নার চুলা থেকে শিল্পের চাকাও ভুগছে গ্যাস সংকটে। আর গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বেড়েছে লোডশেডিং। জ্বালানি স্বল্পতার কারণে সন্ধ্যায় ১২০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হচ্ছে। ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে গড়ে উৎপাদন ১২ হাজার ৮১৮ মেগাওয়াট।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। এলএনজি কেনা না হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই আপাতত। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজি’র দাম ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কম থাকায় লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের এসিসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহারে আরও সচেতন হতে হবে। পাশিপাশি সরকারেরও কড়া নজরদারি দরকার।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। তাই লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক কার্যক্রমে। শিল্পকারখানার উৎপাদনে স্থবিরতা চলে এসেছে, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে জরুরি সেবা। পচন ধরছে হিমাগারের খাদ্যে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ঘটছে ছন্দপতন।
পেট্রোবাংলার হিসাবে, একশ’ কোটি ঘনফুট এলএনজি আনার কথা থাকলেও আসছে ৫০ কোটিরও কম। অন্যদিকে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তবে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের হার সবচেয়ে বেশি। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থা বা আরইবি। প্রতিদিনই বাড়ছে তাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি। লোডশেডিংয়ের কারণে আমন মৌসুমের ধান চাষ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। বর্ষার শ্রাবণ মাসেও দেখা মিলছে না প্রত্যাশিত বৃষ্টির। গরমের ফলে বেড়েই চলেছে বিদ্যুতের চাহিদা। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, যে উদ্দেশ্যে লোডশেডিং করা হচ্ছে তা এক ঘণ্টায় কাজ না হলে পরের থেকে দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হবে। এ ছাড়া চাহিদা কমাতে সরকারি অফিস দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকেরা তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে অভিযোগ করছেন দুইদিন ধরে। তিতাস সূত্র বলছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বারিধারা, বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় একদমই গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। আর কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। কোনোরকমে রান্নার চুলা জ্বলছে এসব এলাকায়। সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকার শিল্পকারখানাও গ্যাসের অভাবে উৎপাদন করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে।
বর্তমান বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে টোকিও বাংলা নিউজের সঙ্গে কথা হয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সঙ্গে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, বিদ্যুৎ-জ্বালানীর বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমাদের পরিকল্পনাকে দায়ী করেছেন এই অধ্যাপক।
টোকিও বাংলা নিউজ: আমাদের বিদ্যুৎ-জ্বালানী খাতে যে ভয়াবহ সংকটের সূচনা হয়েছে তার জন্য কি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দায়ী?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: বিদ্যুৎ-জ্বালানী খাতে সংকটের সঙ্গে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। এটি শুধু অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্য দেশগুলো যারা বিদ্যুৎ-জ্বালানী সংকটে পড়েছে, তারাও একই অজুহাত দিচ্ছে। যুদ্ধ না থাকলেও এই সংকট তৈরি হতো। যুদ্ধ শুধু এই সংকটকে তরান্বিত করেছে, যুদ্ধ না হলে এই সংকট কিছুদিন পর হতো। কিন্তু এই সংকট সামনে আরো বাড়বে।
সরকারকে বহুবার আমরা এই ব্যাপারগুলোতে সতর্ক করলেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নাই। সরকার বুঝে-শুনে বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়েছে। যেই বিদ্যুৎখাতে এতো ভর্তুকি দেওয়া হলো তাহলে কেন সংকট দেখা দিল! এই খাতে ভর্তুকি তো যেনতেন নয় যে ভুলে যাওয়া যাবে! এর মানে হচ্ছে গ্রাহকরা টাকা দিয়েই যাচ্ছেন। একবার ভর্তুকি হিসেবে আরেকবার গ্রাহক হিসেবে। এতো 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'!
টোকিও বাংলা নিউজ: বিদ্যুৎ-জ্বালানী খাতে এই সংকটের জন্য মূলত তাহলে কোন কারণ দায়ী বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: বিদ্যুৎ-জ্বালানী খাতে সংকটের মূল কারণ সরকারের 'মহাপরিকল্পনা'। কারণ এই মহাপরিকল্পনা করেছে বিদেশীরা। তাই এই মহাপরিকল্পনার পুরোটাই ঋণ ও আমদানী নির্ভর ছিল। একদিকে বিদেশী ঋণ ও আমদানী, আরেকদিকে পারমাণবিক বিদ্যুতের পাশাপাশি এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ। এলএনজি আমদানী এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ হচ্ছে দেশের জন্য বিপর্যয়। এই মহাপরিকল্পনায় বিদেশী কোম্পানি ও সহযোগী হিসেবে দেশীয় কিছু কোম্পানি রয়েছে। তাই বোঝাই যাচ্ছে এই মহাপরিকল্পনা কর্পোরেট গ্রুপগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
টোকিও বাংলা নিউজ: এই সংকট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আপনি মনে করছেন?
টোকিও বাংলা নিউজ: বিদ্যুৎ-জ্বালানী খাতের এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: শুধুমাত্র আমদানী ও ঋণভিত্তিক ত্বত্ত থেকে সড়ে এসে জাতীয় জ্বালানী নিরাপত্তা ও জ্বালানী সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কয়লা উত্তোলন তো দূরে থাক, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসতে হবে। এলএনজি আমদানী থেকে সরে আসতে হবে। তাহলে চলমান বিদ্যুৎ-জ্বালানী সংকট থেকে মুক্তি আসবে। বিদেশী ঋণ আনতে হবে না। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে এবং দামও কমে আসবে।
আর এ