আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা লোকসান দেখিয়ে এক ধাক্কায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হলো। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ডিজেল আমাদের কিনতে হলেও অকটেন এবং পেট্রোল আমাদের কিনতে হয় না। আমরা যেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করি সেখান থেকে এটা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে রিফাইন করে পেট্রোল এবং অকটেন দুটো-ই পাই। যার কারণে চাহিদার চেয়েও অকটেন এবং পেট্রোল আমাদের মজুদ রয়েছে। বরং অনেক সময় আমরা আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি পেট্রোল এবং অকটেন রপ্তানীও করি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমদানি করা ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিকাজে সেচের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে ৩১ হাজার ৮৩৫ মেট্রিকটন ডিজেল, জেট ফুয়েল ৬২ হাজার ৮৯১ মেট্রিকটন মজুদ রয়েছে। বিপিসি যদি আমদানি না করে তাহলে ডিজেল চলবে ৩২ দিন এবং জেট ফুয়েল ৪৪ দিন চলবে। বিপিসি কখনোই আমদানি বন্ধ করবে না। বিপিসির আগামী ছয় মাসের আমদানি পরিকল্পনা নিশ্চিত করা আছে।
নিজের গবেষণার সাফল্যেকে বাস্তব রূপ দিতে আমেরিকায় প্লান্ট গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করতে চাচ্ছি। এই জন্য ২০১৮ সাল থেকে আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়েছি। ২০১৯ সালেও বাংলাদেশে এসেছি। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, পাবনাসহ দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশন মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করেছি। মৌখিকভাবে সংশ্লিষ্ট সকলে সম্মতি জ্ঞাপন করলেও এরপর কোন অদৃশ্য কারণে সবাই নীরব হয়ে যান।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই সঙ্কট আরও বাড়বে। সঙ্কটের মুখে সরকার এখন ডিজেলের ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দিচ্ছেন। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয়, যা অন্যান্য তেলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
তবে আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশী বিজ্ঞানী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. মঈনুদ্দিন সরকারের মতে, বাংলাদেশ কেন ডিজেল আমদানী করবে! বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ 'রিসোর্স' আছে ডিজেল ও জেট ফুয়েল উৎপাদনের জন্য। সেগুলোর যথোপযুক্ত ব্যবহার করলে দেশে কখনোই ডিজেলের 'সংকট' হবে না।
বাংলাদেশে জ্বালানীর সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে টোকিও বাংলা নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ড. মঈনুদ্দিন সরকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মো. শামীম রহমান।
টোকিও বাংলা নিউজ: জ্বালানী মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট নিরসনে কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন?
ড. মঈনুদ্দিন সরকার: আসলে এখন সময় হয়েছে জ্বালানীতে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠার। আমদানী অথবা বিদেশী কোম্পানি নির্ভর হয়ে থাকলে সময়ে সময়ে মূল্যবৃদ্ধি হবেই এবং সংকট নিরসন সাময়িকভাবে হলেও পরবর্তী সময়ে আবার দেখা দিবে। তাই দেশেই সকল জ্বালানী উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। শুধু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সকল ধরনের সহযোগিতা পেলেই এই সংকট স্থায়িভাবে নিরসন সম্ভব, বিশেষ করে ডিজেল, এলপিজি ও জেট ফুয়েলের ক্ষেত্রে।
টোকিও বাংলা নিউজ: কিভাবে বাংলাদেশেই ডিজেল, এলপিজি ও জেট ফুয়েলের উৎপাদন সম্ভব?
ড. মঈনুদ্দিন সরকার: পরিত্যক্ত বা ফেলে দেওয়া যাই বলি না কেন বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে ডিজেল, এলপিজি ও জেট ফুয়েলের উৎপাদন সম্ভব। অবাস্তব মনে হলেও বর্জ্য প্লাস্টিকেই লুকিয়া আছে এই সংকট নিরসনের উপায়। দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ধরে কঠোর গবেষণার পর বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে ডিজেল, এলপিজি ও জেট ফুয়েল উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সক্ষম হই। আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে একটন বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে ১৩০০ লিটার ডিজেল, ১০০ কেজি এলপি গ্যাস এবং ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮৭ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য নদী, খালসহ পরিবেশ দূষণ করছে। দিন দিন এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা বিঘ্নিত হবে। তাই এই সকল সমস্যার সমাধান একমাত্র আমার প্রযুক্তিতে রয়েছে। চিন্তা করুন এতো পরিমাণ বর্জ্য প্লাস্টিক দিয়ে বছরে আনুমানিক ডিজেল এক লাখ ১৩ হাজার ১০০ মেট্রিকটন (১১ কোটি ৩১ লাখ লিটার), জেট ফুয়েল ২ হাজার মেট্রিকটন (২০ লাখ এক হাজার লিটার) এবং এলপিজি ৮ হাজার ৭০০ মেট্রিকটন (৮৭ লাখ কেজি) উৎপাদন সম্ভব। আর এই জ্বালানী উৎপাদনে খরচ হবে বর্তমান জ্বালানী আমদানী অথবা উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে যেখানে জেট ফুয়েলের দাম ১৩০.০০ টাকা প্রতি লিটার এবং এলপি গ্যাস ১২.৫০ কেজির প্রতি সিলিন্ডার ৫৯১ টাকা।
টোকিও বাংলা নিউজ: আপনার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এতো ভাল তার প্রমাণ কি?
ড. মঈনুদ্দিন সরকার: আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তির জন্য কোন ধরনের পরিবেশ দূষণও হবে না। আমি আমেরিকায় আমার গবেষণাকে বাস্তবে সফলভাবে শেষ করেছি। আর আমেরিকার মত উন্নত দেশে কোন খারাপ প্রযুক্তির আপনি স্বীকৃতি নিতে পারবেন না, এখন আপনি যত অর্থেরই মালিক হোন না কেন। কেউ কোন কিছু দাবি করলে তা সরকারের আওতাধীন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। আর আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ৬টি আমেরিকান 'পেটেন্ট' রয়েছে। যার মধ্যে দুইটি আন্তর্জাতিক পেটেন্ট।
টোকিও বাংলা নিউজ: যেহেতু বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে জ্বালানী উৎপন্ন হবে, সেহেতু আপনার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পরিবেশ রক্ষার্থে কি ভূমিকা পালন করবে?
ড. মঈনুদ্দিন সরকার: সারা দুনিয়ায় দিনে দিনে বাড়ছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, সেই সঙ্গে আমাদের চার পাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা হয়ে ওঠেছে আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্লাস্টিক পচনশীল নয় বিধায় মাটি হারাচ্ছে তার উর্বর শক্তি। খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাষন ব্যবস্থা রোধ হচ্ছে ফলে মশামাছির প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে এবং বৃষ্টিহলে শহরে নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্রাদুর্ভাবে বন ও জলজজীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। আমাদের এক প্রযুক্তিতে এই সকল সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।
টোকিও বাংলা নিউজ: তাহলে আপনি বাংলাদেশী হয়েও দেশে আপনার প্রযুক্তির প্লান্ট স্থাপনে কাজ করছেন না কেন?
ড. মঈনুদ্দিন সরকার: নিজের গবেষণার সাফল্যেকে বাস্তব রূপ দিতে আমেরিকায় প্লান্ট গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করতে চাচ্ছি। এই জন্য ২০১৮ সাল থেকে আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়েছি। ২০১৯ সালেও বাংলাদেশে এসেছি। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, পাবনাসহ দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশন মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করেছি। মৌখিকভাবে সংশ্লিষ্ট সকলে সম্মতি জ্ঞাপন করলেও এরপর কোন অদৃশ্য কারণে সবাই নীরব হয়ে যান। অথচ বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির কেন্দ্র স্থাপন হলে একাধারে যেমন দেশকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি দেশের স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে এবং জ্বালানী সংকট চিরতরে দূর হবে। কিন্তু আমার একার পক্ষে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখানে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অর্থায়ন প্রয়োজন। সরকারের প্রতি অর্থবছরে জ্বালানী ও পরিবেশের জন্য যে বাজেট থাকে তার একটি অংশ এই প্রযুক্তির প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ করলে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি জ্বালানীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।
আর এ