টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের চলতি আসর থেকে সর্বপ্রথম বাদ পড়া বাংলাদেশ দলের চরম ভরাডুবিতে হতাশার অতল তলায় নিমজ্জিত এর অযুত,নিযুত ভক্তদল। এ নিয়ে নানাজনের নানা কথা,নানা মত!বোলিং-ব্যাটিং যেনতেন,ফিল্ডিং দেখে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে বিশ্বকাপের দলই মনে হয়নি অনেকের কাছে!
প্রিয় দলের এমন অপ্রত্যাশিত বাজে পারফর্মেন্স ক্ষুদ্ধ,হতাশ,মর্মাহত অনুরাগীদের মনে জন্ম দিয়েছে এবার নানা জিজ্ঞাসা।এ নিয়ে নানাজন বলছেন নানা কথা।কিছু কিছু আবেগী ভক্ত, অনুরাগী একেকদিনের একেকটা ছেলেখেলা টাইপ পরাজয়ের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বা একাধিক ক্রিকেটারের ভুলভ্রান্তির পোস্টমর্টেম করে পরাজয়ের গ্লানি ভোলার,মনের জ্বালা কমানোর অপচেষ্টা করলেও বেশিরভাগ এবার কষছেন অন্য অনেক হিসেব নিকেশ।কেউ কেউ তাচ্ছিল্যে, কেউ আবার বিশেষজ্ঞ মতামতে শুধু জাতীয় ক্রিকেট দল নয়,বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টমর্টেম করছেন নানা মতামতে।বলছেন নানা কথা হাট- বাজারে,রাস্তা-ঘাটে,অথবা টি স্টলে।নিত্য উঠছে ঝড় এ নিয়ে এখনো চায়ের কাপে।
চলতি টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল, আমাদের অহংকারের টাইগার্সরা আসলে কাগুজে বাঘ ছিলো নাতো?নাকি মিরপুরের হোম কন্ডিশনের উইকেটে যারা বাংলার বাঘ,তারা আসলে বাইরের মানে অ্যাওয়ে কন্ডিশনের সব উইকেটে স্রেফ নিরীহ বিড়াল ছানা!এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।
বিশ্বকাপের অব্যবহিত পূর্বে,বলা চলে প্রায় প্রস্তুতিকালে বাংলাদেশ সফরকারী জিম্বাবুয়ে,অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলের একতরফা,মারকুটে পারফর্মেন্সের সাথে প্রায় অভিন্ন বিশ্বকাপ দলের পারফর্মেন্সের হিসেব মেলাতে পারছেন না কেউ,কিছুতেই।
জিম্বাবুয়েকে বাংলাদেশ হোয়াইট ওয়াশ করে সব ফরমেটের ক্রিকেটে।অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও টি টুয়েন্টি সিরিজ জিতে বাংলাদেশ একতরফা ব্যবধানে।এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো এলিট দল তাদের সর্বনিম্ন স্কোর ৬২ রানে পরাজয়ের ইতিহাসও গড়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে এই ক'দিন আগে।তাহলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের এমন বাঘা পারফর্মেন্স দুই-চার-ছয় মাস যেতে না যেতে হাওয়াই মিঠাই'র মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো কি করে!নাকি সফরকারী দলের শক্তিমত্তা আর তাদের বিপক্ষে জেতায় শুভঙ্করের কোনো ফাঁকি ছিলো?এমন যুক্তি যারা দেখাচ্ছেন,তাদের তা খণ্ডানো যাবে কোন যুক্তিতে?
আবার কারো কারো ভাষ্য,বারবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলে,জিতে বাংলাদেশের রেকর্ডের পাল্লা হয়তো ভারি হয়েছে।কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই।এদিকে আফগানিস্তান,স্কটল্যান্ড আর নামিবিয়ার মতো দলের সামর্থ্য বিষয়ে বাংলাদেশ আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলো বলে মনে হয়না!বড় দলগুলোর কথা বাদ,এসব দলের বিপক্ষে স্মরণাতীত কালের মধ্যে বাংলাদেশ কি কারণে কোনো সিরিজ আয়োজন করেনি বা করতে পারেনি,তা আমজনতার জানার কথা নয়।বিষয়টা ভালো বলতে পারবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
আসলে বিশ্বকাপ শুরুর আগে উপরোল্লেখিত তিনটি দলের বিপক্ষে আয়োজিত হোম সিরিজে বাংলাদেশ দলের হাই ভোল্টেজ পারফর্মেন্স দেখে ভক্তদের প্রত্যাশার পারদ এবারকার টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপকে ঘিরে একটু উর্ধ্বমুখী ছিলো বৈকি।তবে কখনোই তা গগনচুম্বী হয়নি।বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে,এ আশা কোনো ভক্ত স্বপ্নেও কখনো করেনি।তবে প্রিয় দল,দেশের জাতীয় দল এবার অন্তত সেমিফাইনাল খেলবে,সবার এ আশা নিশ্চয়ই অতি উচ্চাশা ছিলোনা।
সেক্ষেত্রে দলের এমন ভরাডুবিতে ভক্তদল যারপরনাই হতাশ,ক্ষুদ্ধ,মর্মাহত!
বিষয়টা দুঃখজনক,অপ্রত্যাশিত হলেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেলা দেখা অনেকেই তা মানতে নারাজ।তাদের অভিমত,যেমন খেলেছে এবার বাংলাদেশ দল,তেমন ফলাফল ই পেয়েছে।কোয়ালিফাইং রাউন্ড থেকে শুরু করে সুপার টুয়েলভ্ এর তিনটি ম্যাচের মধ্যে একমাত্র পাপুয়ানিউগিনির বিরুদ্ধে জয়,আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরাজয় দর্শকমহল মানতে রাজি।কেবলমাত্র এ দুই জয়-পরাজয় বাংলাদেশ আর ওই দুই দলের সামর্থ্য আর অসামর্থ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বলে সাধারণ দর্শকদের অভিমত।
বাকি সব ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে যাচ্ছেতাই ভাবে।ক্ষুদ্ধ ভক্তদলের অভিমত,সার্বিক পারফর্মেন্সে সুপার টুয়েলভ্ এর বারো দলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আসলে বারোতম!এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার দরকার নাই।করতে গেলে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হওয়ারও প্রয়োজন নাই।তবে কি আমাদের অভিজ্ঞতায় ঘাটতি ছিলো?তাহলে আর কতো অভিজ্ঞতা দরকার ছিলো আমাদের জাতীয় দলের?
আসলে আমাদের ঘাটতি কি?মূল সমস্যা কোথায়?আমাদের আছে বিত্তশালী,শক্তিশালী ক্রিকেট বোর্ড।অবশ্য সব দেশের ক্রিকেট বোর্ড ই এখন বিত্তশালী।এককালের রাজকীয় খেলা ক্রিকেট এখন আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছলতার খেলা।
বোর্ডে সভাপতি,পরিচালকবৃন্দ ছাড়াও আছেন নির্বাচক,পরামর্শক এবং বিষয়ভিত্তিক কোচার বা প্রশিক্ষক।তবে এবার অনেকেরই অভিযোগের আঙুল উঠেছে ফিল্ডিং কোচের দিকে।বেশিরভাগই এবার তার পদত্যাগের কথা বলছেন।ক্যাপ্টেন,হেড কোচ,বোর্ড প্রেসিডেন্ট বা অন্য কারও নয়।
শোনা যায় ফিল্ডিং কোচ ই নাকি বাংলাদেশ দলের সাথে আছেন সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে।আর ফিল্ডিং এ ই জাতীয় দল এবার দেখিয়েছে যাচ্ছেতাই পারফর্মেন্স।দলের এতে উন্নতি তো হয়ই নি,উল্টো অবনতি এবার দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিলো।
আসলে আমরা তো এমনিতেই আবেগী জাতি।সাফল্যে মাথায় তুলতে যেমন আমাদের সময় লাগেনা,তেমনি ব্যর্থতায় পিণ্ডি চটকাতেও আমরা ছাড় দেইনা।এবারও তার কিছুটা নমুনা দেখা গেছে।পাশাপাশি আমাদের দর্শক, ভক্তদের চিন্তাধারায় পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে।একেকদিনের একেকটা যাচ্ছেতাই হারের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের কেউকেউ লিটন দাস,মাহমুদ উল্যাহ,মুস্তাফিজ আর মেহেদীর দিকে তাচ্ছিল্যের আর সমালোচনার আঙুল তুললেও বেশিরভাগ কিন্তু এবার বলছেন,আসলে আমাদের খেলোয়াড়দের সামর্থ্যের দৌড় ওটুকুই।কাজেই কেনো আর অসারের তর্জনগর্জন?কেনো আর গরীব দেশের জনগণের টাকায় শ্বেতহস্তী পোষণ?
সবকথার শেষকথা আসলে ওই আবেগ।যা মোটেই খারাপ জিনিশ নয়।ভালোবাসা থেকেই এর উৎপত্তি।তা থেকেই আবার প্রত্যাশা,হতাশা আর নিরাশার জন্ম।ক্রিকেট এখন আমাদের দেশ ও জাতির জন্যে মোটেই আর নিছক কোনো খেলা নয়।এ এখন আমাদের জাতীয় আবেগ আর ভালোবাসা,যার অপর নাম দেশপ্রেম!ঘুরিয়ে বললে,দেশ,পতাকা আর মানচিত্রের জন্যে আবেগ আর ভালোবাসার আরেক নাম এখন ক্রিকেট।আমাদের ক্রিকেটাররা এখন শুধু যে ছোট পর্দায় দেশী-বিদেশী পণ্যের মডেল,তা কিন্তু নয়।বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা অনেক আগে থেকেই দেশে-বিদেশে দেশ,জাতি, মানচিত্র আর পতাকার ব্রান্ড এম্বাসেডর।
বিশ্বের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ যেনো এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট।অনেকসময় কাকপক্ষী শূন্য বিদেশ, বিভুঁইয়ের গ্যালারিতে জাতীয় পতাকা হাতে প্রবাসীদের গগনবিদারী বাংলাদেশ বাংলাদেশ রব কি তার পরিচায়ক নয়?
জানিনা এ দীঘল রচনা বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাল আমলের দণ্ডমুণ্ডের কোনো কর্তার নজরে আদৌ পড়বে কিনা!তবে দু'চারজন ক্রিকেট পাগলের চোখেও যদি তা পড়ে,মন্দ কি?ভালো কিছুর জন্যে নিশ্চয়ই আমরা সবসময় আশায় বুক বাঁধবো।সে মোতাবেক আমাদের ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা যুৎসই,লাগসই এবং টেকসই কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন,এ আশাও ক্রিকেট প্রেমী জনতার।কিন্তু উলুবনে এতদ্বিষয়ে মুক্তা ছড়ানো নিশ্চয়ই আর নয়।কারণ,সেই ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয় আর ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর মেঘে মেঘে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বয়ে যাওয়া বেলা তো আর একেবারে কমও নয়।
আর সি